চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ

 চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ

The Earth

বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে আমাদের এই মহাবিশ্ব গঠিত । আধুনিক বিজ্ঞান তো বলে মাহাবিশ্ব শুধু একটা নয় এর রয়েছে আরো কোটি কোটি প্রতিরূপ । এবং বুদবুদের মতো করে তৈরি হচ্ছে আরো মহাবিশ্ব। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় মাল্টিভার্স বলে । 

অন্তহীন এ মহাবিশ্বের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার স্থান দখল করে আছে আমাদের এই সৌরজগৎ । যার কারণ প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা আমাদের নীল গ্রহ পৃথিবী । এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান হাজার হাজার আলোক বর্ষ দূরের গ্রহ নক্ষত্রে সন্ধান চালিয়েও কোথাও জীবনের সন্ধান পাননি । ভবিষ্যতে যদি পেয়ে যান তখন না হয় পৃথিবীর সাথে ঐ গ্রহের মর্যাদার স্থান ভাগাভাগি করে নেওয়া যাবে । ততদিনে মাল্টিভার্স বা ইউনিভার্সের মধ্যে আমাদের পৃথিবীই সেরা । ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হয় একটি নীল গোলক । যার কারনে পৃথিবীকে নীল গ্রহ বলে । আমরা জানি সূর্যের সাদা আলো বেনীআসহকলা অর্থ্যাৎ বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল রঙ্গের মিশ্রণে তৈরি । এর মধ্যে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে খাটো ।

তাই সূর্যের আলো যখন আমাদের পৃথিবীর বায়ূমন্ডলে প্রবেশ করে তখন বায়ূমন্ডলে থাকা গ্যাসের কারণে দীর্ঘ তরঙ্গের আলোকরশ্মি সোজা প্রবেশ করলেও নীল রঙ্গের আলোক রশ্মির বিক্ষেপন বেশি হয় । যার কারণে নীল রং ছড়িয়ে পড়ে । ফলে  পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখলে মনে হয় একটি নীল গোলক । 

এছাড়াও আরো একটি কারণে পৃথিবীর নীল রংটিই বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো আমরা জানি পৃথিবী ৭০% ই জল । অধিক জলের উপস্থিতির কারণে পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্য থেকে পৃথিবীকে দেখলে নীল দেখায়। যাই হোক আমরা নীল গ্রহের বাসিন্দা ।  ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

এই পৃথিবী থেকে সূর্যের আকৃতি অনেক অনেক গুণ বড় । বিজ্ঞানীরা বলেন, ১৩ লক্ষ গুণ বড় । সূর্য থেকে আকাশের তারকাগুলো আরো বড় । এইসব বিশাল বিশাল আকৃতির গ্রহ নক্ষত্রগুলো একটির সাথে আরেকটি এমনভাবে অবস্থান করছে যে, একটির পথ অন্যটি অতিক্রম করে না । মুসলিম বিজ্ঞানী আল বেরুনী ১১শতকে এই তথ্যের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন । এই মহাবিশ্বের প্রত্যেক বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে । এই আকর্ষণ শক্তিকে বলে মহাকর্ষ । 

আরো পড়তে পারেন

এই আকর্ষণ শক্তির মান বস্তুর ভরের গুণফলের সমানুপাতিক, দুরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক । এভাবে বস্তুর দূরত্ব বেশি হলে আকর্ষণ শক্তি হ্রাস পায় । দূরত্ব কম হলে আকর্ষণ শক্তি বৃদ্ধি পায় । এই বিশাল মহাবিশ্বের গ্রহ নক্ষত্রগুলো এই মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে একটা ব্যালেন্স পজিশনে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে । গ্রহ নক্ষত্র গুলো এই আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পরস্পরের কাছে আসতে প্রবল আগ্রহী । ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

তারমধ্যে আরেকটি শক্তি রয়েছে, তার নাম সম্প্রসারণ শক্তি । এই সম্প্রসারণ শক্তির কারণেই ইচ্ছা থাকলেও গ্রহ নক্ষত্রগুলো পরস্পর একত্র হতে পারে না। মহাশূন্যে নক্ষত্রগুলো অবিরাম ঘূর্ণনের ফলে তাদের কক্ষিয় গতি থেকে উৎপন্ন হয় প্রচন্ড এক শক্তি যার নাম হলো কেন্দ্রাতিগ শক্তি । এই শক্তি বস্তুর ওজনের গুনফলের সমানুপাতিক এবং বিপরীতভাবে বস্তু থেকে আরেক বস্তুর পৃথক হয়ে থাকার দূরত্বের বর্গের সমানুপাতিক । এ কারণে নক্ষত্রগুলো খসে পড়ে না । একটির সাথে আরেকটির কোন সংঘর্ষ ঘটে না ।

বিজ্ঞানীগণ বলেন, পৃথিবীর বুকে সৃস্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত যতটা শক্তি ব্যয়িত হয়েছে তা সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ব্যয় করছে । শুধু তাই নয় জলন্ত সূর্যের সম্মুখ ভাগ থেকে এক প্রকারের জ্বালানি গ্যাস নির্গত হয় বিজ্ঞানীরা যার নাম দিয়েছেন স্পাইকুলাস (Spyculas) । 

প্রতি সেকেন্ডে এই গ্যাস ৬০,০০০০ (ষাট হাজার) মাইল বেগে নির্গত হচ্ছে । এই গ্যাস যদি কোন ক্রমে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে তাহলে মূহুর্তে গোটা পৃথিবী জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে । প্রচন্ড ক্ষমতা সম্পন্ন এই গ্যাস যে তীব্র গতিতে সূর্য থেকে নির্গত হচ্ছে সেই একই গতিতে সূর্যের দিকে প্রত্যাবর্তিত হচ্ছে ।  ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )


জলন্ত সূর্যের সম্মুখ ভাগ থেকে এক প্রকারের জ্বালানি গ্যাস নির্গত হয়

বিজ্ঞানীগণ বলেন, এই পৃথিবী সূর্য থেকে যতটা দূরত্বে অবস্থান করছে সেখান থেকে সূর্য যদি কয়েক ডিগ্রি উপরে উঠে যায় তাহলে গোটা পৃথিবী মূহুর্তে প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে বরফে পরিনত হবে । আবার সূর্য যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে সূর্য যদি কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে আসে তাহলে মূহুর্তে গোটা পৃথবী জ্বলে পুড়ে ছাই হবে । 

আমাদের চাঁদ মামা যেখানে অবস্থান করছে সেখান থেকে যদি কয়েক ডিগ্রি উপরে উঠে যায় তাহলে সমস্ত পৃথিবী শুস্ক মরু প্রান্তরে পরিনত হবে । আবার যদি চাঁদ মামা কয়েক ডিগ্রি নিচে নেমে আসে তাহলে সমস্ত পৃথিবী জলের তলায় তলিয়ে যাবে । 

শুধু তাই নয় সূর্যের আল্ট্রা ভাইওলেট রে (Ultra Violet Ray ) অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীর জন্য চরম ক্ষতিকর । মারাত্বক ক্ষতিকর এই রে পৃথিবীতে যেন পৌঁছাতে সক্ষম না হয় এর জন্য রয়েছে ওজন স্তর । যা আমাদের কে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করছে । 

তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষের বিভিন্ন কাজে বিশেষ করে এয়ার কুলার এবং রেফ্রিজারেটরে ব্যবহার করা ক্লোরো ফ্লোরো কার্বনের কারণে ওজন স্তর ফাটল ধরেছে । ভবিষ্যতে যা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক । ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

একটি গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার জন্য যে ধরণের শর্তগুলো রয়েছে তার সবই আমাদের পৃথিবীতে বিদ্যমান । যেমন: তরল পানি, কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি।

পৃথিবী পৃষ্ঠের ৪৬.৬ শতাংশ অক্সিজেন, ২৭ শতাংশ সিলিকন, ৮.১ শতাংশ অ্যালোমিনিয়াম, ৫ শতাংশ লোহা, ৩.৬ শতাংশ ক্যালসিয়াম ২.৮ শতাংশ সোডিয়াম, ২.৬ শতাংশ পটাশিয়াম, ২ শতাংশ ম্যাগনেশিয়াম এবং অন্যান্য উপাদান ১.৬ শতাংশ ।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এই পৃথিবী ৪টি স্তরে বিভক্ত । সর্বাপেক্ষ অভ্যন্তরের স্তর কে ইনারকোর (Inarcore) নামে অবহিত করা হয়েছে । এই ইনারকোর কঠিন লোহা দিয়ে প্রস্তুত । ইনারকোরের ব্যাসার্ধ প্রায় ১ হাজার ৬শত কিলোমিটার ।

এই পৃথিবী ৪টি স্তরে বিভক্ত

 আউটারকোর (Outercore) ইনারকোরকে আবৃত করে রেখেছে । এই আউটারকোর তরল  লোহা দিয়ে তৈরি । এর সাথে ২০ ভাগ নিকেল রয়েছে । আউটারকোরের ব্যাসার্ধ প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার । 

আউটারকোরের উপরের অংশকে ম্যান্টেল (Mantle) বলে । ম্যান্টেল প্রধানত অক্সিজেন, সিলিকন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও লোহার তৈরি যৌগিক পদার্থের সমন্বয়ে গঠিত । 

আরো পড়তে পারেন

ম্যান্টেলের ব্যাসার্ধ ২৯২০ কিলোমিটার । ম্যান্টেল কোরের উপরের অংশকে ক্রাস্ট (Crust) বলে । পৃথিবীর সকল প্রাণী ও উদ্ভিদ এ ক্রাস্টের উপরেই অবস্থান করছে । এই ক্রাস্ট প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার এবং সমুদ্রের তলদেশে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু । 

ম্যান্টেল উপর অংশের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত একটু ভিন্ন গুনাবলী সম্পন্ন । ক্রাস্ট এবং ম্যান্টেলের উপরের অংশ সম্মুলিত ভাবে লিথস্পিয়ার (Lithosphere) প্রস্তুত করে । লিথস্পিয়ার অত্যান্ত দৃঢ় ভাবে গঠিত এবং ৭ টি বিরাট আকারের খন্ডে বিভক্ত । 

এগুলোকে কন্টিনেন্টাল প্লেটস (Continental Plates )  বলে । পৃথিবীর ৭ টি মহাদেশ এই ৭টি প্লেটের উপর অবস্থিত । লিথস্পিয়ারের নিচের অংশকে এ্যাসথোনস্পিয়ার প্লেটস (Asthinosphere Plates )  বলে । 

পৃথিবী অভ্যন্তর ভাগের তাপমাত্রা প্রায় ৪০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট । এবং যতই উপরের দিকে আসা যাবে ততই তাপমাত্রা হ্রাস পেতে থাকে । পৃথিবীর ভিতর থেকে বাহিরের দিকে আসার সময় এ্যাসথোনস্পিয়ার কনভেকশন কারেন্ট প্রস্তুত করে । 

এই কারেন্ট বা স্রোত ভূপৃষ্ঠের উপরের অংশে ধাক্কা দেয় এবং সমান ভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । এ্যাসথোনস্পিয়ারের এই কনভেকশন কারেন্টে কারণে কন্টিনেন্টাল প্লেটস অত্যান্ত ধীর গতিতে চলতে থাকে ।  

প্লেটগুলো যখন চলতে থাকে তখন একটির সাথে আরেকটি ধাক্কা খায় । যার ফলে একটি প্লেট অন্যটির নিচে চলে যায় । যে স্থানে এরকম ঘটবে সেই স্থানকে কলিসন জোন (Collision Zone) বলে । সেখানে প্লেটের কিনারা বাকা হয়ে পর্বতমালা সৃষ্টি করে । বিজ্ঞানীগণ বলেন হিমালয় পর্বত এই প্রক্রিয়াতেই সৃষ্টি হয়েছে । ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

একই কারনে ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির উদগিরন হতে পারে । আগ্নেয়গিরি থেকে নিগত লাভা দিয়ে পবতমালা সৃষ্টি হতে পারে । যেমন হয়েছে আন্দিজ পবর্তমালা ।

 পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় নিকটবর্তী গ্রহ

পৃথিবী সূর্যের তৃতীয় নিকটবর্তী গ্রহ। আর আয়তনের দিক থেকে পৃথিবী হলো পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ । সূর্য থেকে পৃথবীর দূরত্ব ১৪ কোটি ৯৬ লক্ষ কিলোমিটার । পৃথিবীর ব্যাস ১২ হাজার ৭ শত ৫৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার । আর ভর ৬.৬ সেক্সটিলিয়ন । 

পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে  ঘোরে । সূর্যকে ঘুরে আসতে পৃথিবী সময় নেয় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ৯ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড । এদিকে পৃথিবী নিজের অক্ষপথেও ঘুরে পৃথিবীর এই গতিকে বলে আহ্নিক গতি । পৃথিবী নিজের অক্ষপথে ঘুরে আসতে সময় নেয় ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট । যাকে আমরা ১ দিন বলি ।

পৃথিবীর আকার অনেকটা কমলা আকৃতির । পৃথিবীর এক মেরু থেকে আরেক মেরুর দূরত্ব ৭ হাজার ৮ শত ৯৯ দশমিক ৮৩ মাইল। আর নিরক্ষীয় রেখা বরাবর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব এক মেরু থেকে আরেক মেরুর দূরত্বের তুলনায় ২৭ মাইল বেশী ।

পৃথিবী পৃষ্ঠের আয়তন ১৯ কোটি ৬৯ লক্ষ ৫১ হাজার মাইল। তার মধ্যে ভূ- ভাগ হল মাত্র ৫ কোটি ৭২ লক্ষ ৫৯ হাজার মাইল। পৃথিবীর প্রায় ৫ ভাগের ৩ ভাগ পানি । পৃথিবীতে পানি হলো ১৩ কোটি ৯৬ লক্ষ ৯২ হাজার মাইল । ( চেনা পৃথিবীর অচেনা রূপ )

পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম এলাকা ম্যারিয়ানাস্টে্রঞ্জ । গুয়ামের দক্ষিনে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরে এ এলাকাটি অবস্থিত । এর গভীরতা ৩৬ হাজার ১৯৮ ফুট ।  যেখানেপৃথিবীর সাগার-মহাসাগরের গড় গভীরতা ১২ হাজার ৪শত ৫০ ফুট ।

এই পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে লিবিয়ার আল-আজিজিয়ায় ১৩৬ ডিগ্রি ফরেনহাইট । সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এন্টারটিকার ভৌকষ্টে ‌‌‍‌‌‌ মাইনাস ২৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফরেনহাইট।

আরো পড়তে পারেন

পৃথিবী থেমে গেলে কি হবে ?

ডলারের যত গোপন রহস্য

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন