আমি তখন ছোট । আমার এক মামা সৌদি আরবে থাকতেন । তো তিনি সেখান থেকে ১০০০ রিয়াল বাংলাদেশে প্রেরণ করেছেন । ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য মামির সাথে আমিও ব্যাংকে গিয়েছিলাম । ব্যাংক থেকে আমাদের কে ১০০০ রিয়ালের পরিবর্তে ২৩হাজার টাকার মতো দিয়েছিল । এ ঘটনায় আমি তো অবাক ! ১হাজারের পরিবর্তে ২৩হাজার । তখন আমি জানতাম না যে একেক দেশের মুদ্রার মান একেক রকম কেন ? এ ঘটনার রহস্য আমার কাছে অজানা ছিল । যদিও অনেক বড় হয়ে আমি জানতে পারি একেক দেশের মুদ্রা একেক রকম কেন ? এ আর্টিকেলের মাধ্যমে আজকে আমরা সে প্রশ্নেরই উত্তরই দেওযার চেষ্টা করবো ।
একেক দেশের মুদ্রার মান একেক রকম কেন ? |
একেক দেশের মুদ্রার মান একেক রকম কেন ?
বিশ্বায়নের এ যুগে বৈশ্বিক অর্থনীতির আকার এতটাই বিশাল হয়েছে এখন আর পন্য মুদ্রা ( Commodity Money ) বিনিময়ের মাধ্যম হতে পারে না । যার কারণে দেশে দেশে এত কাগজের মুদ্রার ছড়াছড়ি । কিন্তু সমস্যা হলো বিশ্বের প্রতিটি দেশ তো আর একই মুদ্রা ব্যবহার করে না ।
প্রতিটি দেশেরই রয়েছে আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা । যেমন: বাংলাদেশের টাকা, জাপানের ইয়েন, রাশিয়ার রুবল, তুরস্কের লিরা, ভারতের রুপি, সৌদি আরববের রিয়াল, যুক্তরাষ্ট্রের ডলার প্রভৃতি ।
এখন আমরা যখন বৈশ্বিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করি তখন কিন্তু বিনিময়ের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মুদ্রার জন্য একই মান পাই না । যেমন আপনি যদি ১০ ডলারের কোন একটি পন্য ক্রয় করেন তখন কিন্তু আপনাকে ১০ ডলার শোধ করার জন্য ডলার প্রতি ৮৭ টাকা ধরে বাংলাদেশী প্রায় ৮৭০ টাকা পরিশোধ করতে হবে । এখন প্রশ্ন হলো একেক দেশের মুদ্রার মান কেন একেক রকম? আসলে একেক দেশের মুদ্রার মান নির্ধারিত হয় অনেকগুলো তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে । যেমন:
স্বর্ণমান তত্ত্ব
অতীতে ব্যাংকে স্বর্ণ জমা রেখে কাগুজে মুদ্রা ছাপানো হতো । যার কারনে এগুলোর গায়ে লেখা থাকতো চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে নোটটির সমপরিমান স্বর্ণ দিবে । যাকে বলা হয় Commodity Based Money বা পন্য ভিত্তিক মুদ্রা ।
এখন মনে করুণ বাংলাদেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে Commodity Based Money চালু রয়েছে । এখন বাংলাদেশ যদি রিজার্ভে ১ আউন্স স্বর্ণ জমা রেখে ৮৫০০০ টাকা ছাপায় এবং সম পরিমান স্বর্ণ জমা রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি ১০০০ ডলার ছাপায় তাহলে বাংলাদেশি ৮৫ টাকা সমান ১ মার্কিন ডলার হবে ।
তবে এখন কোন দেশের মুদ্রাই Commodity Based Money না হওয়ায় মুদ্রার মান সরাসরি স্বর্ণ মানের সাথে সম্পর্কিত নয় । তবে কোন দেশ যদি আবার তাদের রিজার্ভের মোট সম্পদের তুলনায় বেশি মুদ্রায় ছাপায় তাহলে সে দেশের মুদ্রার মান কমে যাবে । যাকে বলা হয় মুদ্রাস্ফীতি ।
ধরুন আপনি ১০০ টাকা দিয়ে আগে একটি পন্য ক্রয় করতে পারতেন । এখন মুদ্রাস্ফীতি হওয়ার কারণে ওই একই জিনিস আপনাকে ১৪০ টাকা দিয়ে ক্রয় করতে হবে ।
আরো পড়তে পারেন
মেটাভার্স কি এবং কেন জানুন বিস্তারিত
পার ভ্যালু তত্ত্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বানিজ্য ক্ষেত্রে মুদ্রা ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ২৯টি দেশের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ১৯৪৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ( International Monetary Fund ) বা আইএমএফ - এর ।
আন্তর্জাতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের নির্ভরযোগ্যতার কারনে আইএমএফ তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দেয় প্রতিটি দেশ যেন তাদের দেশের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে নির্ধারণ করে । আইএমএফ এ ব্যবস্থার নাম দেয় পার ভ্যালু ব্যাবস্থা (Par value System) ।
মার্কিন ডলার |
যেহেতু সে সময় মার্কিন ডলার সরাসরি স্বর্ণের সাথে সম্পর্কিত ছিল তাই তখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ আইএমএফ - এর পরামর্শ মেনে মার্কিন ডলার সাপেক্ষে তাদের মুদ্রা মান নির্ধারণ করে ।
১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক ঘোষনার মাধ্যমে ডলারের সাথে স্বর্ণের সম্পর্ক রহিত করেন । ইতিহাসে যাকে নিক্সন শক ( Nixon Shock ) বলা হয় । যার কারণে ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান পার ভ্যালু তত্ত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত হলেও এখন আর সে ব্যবস্থা থাকছে না ।
আরো পড়তে পারেন
লেনদেনের ভারসাম্য তত্ত্ব
মুদ্রার সাথে স্বর্ণের সম্পর্ক রহিত হওয়ার পর কাগুজে মুদ্রাগুলো পরিণত হয় Fiat Money বা হুকুমি মুদ্রায় । এর ফলে কোন বস্তুর সাথে মুদ্রাগুলোর সম্পর্ক না থাকায় বস্তুর চাহিদার উপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান কম বেশি হতে থাকলো যাকে বলে ভাসমান বিনিময় হার (Floating Exchange Rate) ।
অর্থনীতির একটি চিরন্তন সত্য হচ্ছে কোন বস্তুর চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তার মূল্য বৃদ্ধি পাবে । মনে করুন বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি পন্য কিনতে চায় । তাহলে বাংলাদেশকে ওই পন্যের মূল্য মার্কিন ডলারেই পরিশোধ করতে হবে । যার কারণে টাকার বিনিময়ে ডলার কিনতে হবে ।
বাংলাদেশী টাকা |
এখন যদি ডলারের চাহিদা বেড়ে যায় তাহলে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশী টাকার মান কমে যাবে এবং ডলারের মান বেড়ে যাবে । এ কারণে কোন দেশের মুদ্রার মান কমে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য আমদানি-রপ্তানির ভারসম্য বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
কোন দেশের রপ্তানির তুলনায় আমদানির হার বেড়ে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই ওই দেশের মুদ্রার মান কমে যাবে । এই কারনেই স্বাধীনতার পর যেখানে ৭ টাকার বিনিময়ে ১ ডলার পাওয়া যেত সেখানে আজকের দিনে প্রায় ৮৭ টাকার বিনিময়ে ১ ডলার পাওয়া যায় ।
ক্রয় ক্ষমতার সমতা তত্ত্ব
মুদ্রা যখন সোনা রূপার সাথে সম্পর্কিত ছিল তখন তার একটি অন্তর্নিহিত মূল্য ছিল । কিন্তু যখনি এটি Fiat Money তে পরিণত হয় তখন এটি আর কাগজ ছাড়া কিছুই থাকলো না । এখন এই কাগুজে মুদ্রা দ্বারা যে পরিমান পন্য বা সেবা ক্রয় করা যাবে সেটাই তার আসল পরিচয় ।
মনে করুন বাংলাদেশি ৮৭০ টাকা দিয়ে ১ কেজি খাসির মাংস পাওয়া যায় । এখন একই পরিমান খাসির মাংস ক্রয় করতে যদি ১০ ডলার দিতে হয় তাহলে কোনটির ক্রয় ক্ষমতা বেশি ? নিশ্চিই মার্কিন ডলারের । এভাবে ক্রয় ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কোন দেশের মুদ্রার মান নির্ধারিত হয় । যে দেশে পন্য বা সেবা যত সহজ লভ্য সে দেশের মুদ্রার মান তত বেশি ।
আশা করি জানতে পেরেছেন কিসের উপর ভিত্তি করে একেক দেশের মুদ্রার মান একেক রকম হয় । আজ এ পর্যন্ত ভালো থাকবেন । সুস্থ থাকবেন । অন্বেষা.নেট এর সাথে থাকবেন ।
আরো জানতে পারো