শয়তানের বাইবেল : কোডেক্স জিগাস

মানুষ রহস্য পছন্দ করে । এই করাণেই কথিত শয়তানের বাইবেল কোডেক্স জিগাস নিয়ে পৃথিবী জুড়ে এত রহস্য । বিশ্বের বাঘা বাঘা গবেষকরা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত কোডেক্স জিগাস এর রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়নি । এর ফলে রহস্যপ্রেমি মানুষের আগ্রহের কারণে এটি শয়তানের বাইবেল নামে পরিচিতি লাভ করে । আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা সে রহস্যময় পান্ডুলিপিটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো । তো চলুন শুরু করা যাক ।

শয়তানের বাইবেল
শয়তানের বাইবেল

শয়তানের বাইবেল

সময়টা আনুমানিক ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ । বর্তমানের চেক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত বোহেমিয়ার বেনেডিকটাইন পোডলাজাইস মঠের হারম্যান রিকুলাস নামক এক সন্ন্যাসী প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার দায়ে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন । পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান সংকলন করে একটি পান্ডুলিপি তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে যাত্রায় সন্ন্যাসী মৃত্যু দন্ড থেকে রক্ষা পান । কিন্তু শর্ত হলো তাকে  মাত্র এক রাত্রে বইটি লিখে শেষ করতে হবে ।

টানা লেখার ফলেও বইয়ের কিয়দাংশ লেখা শেষ করা গেল না । শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী নরকের রাজপুত্র লুসিফারের নিকট নিজের আত্মা উৎসর্গ করে পান্ডুলিপির কাজ শেষ করার প্রার্থনা জানান । লুসিফার এক মুহূর্তে পান্ডুলিপির কাজ শেষ করে দেন । লুসিফার তার স্বাক্ষর স্বরূপ বইটির ২০৯ পৃষ্ঠায় নিজের একটি ছবি অঙ্কিত করেন । সেই ছবির নামানুসারে এর নাম হয়ে গেল শয়তানের বাইবেল বা ডেভিলস বাইবেল ।

আরো পড়তে পারেন

কেন এটিকে শয়তানের বাইবেল বলা হয়

এটির আসল নাম কোডেক্স জিগাস । কোডেক্স জিগাস এর অর্থ বিশাল পুস্তক । উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত মধ্যযুগের সবচেয়ে বৃহত গ্রন্থ এটি । এটির দৈর্ঘ্য ৩৬ সে.মি এবং প্রস্থ ২০ সে.মি ।এতে মোট ৩২০ টি পৃষ্ঠা ছিল ।  তবে বইটির শেষ দিকের ১০ টির মতো পৃষ্ঠা পাওয়া যায় নি । মনে করা হয়, সরানো পাতাগুলিতে বেনেডিকটাইনদের সন্ন্যাস-সংক্রান্ত নিয়মাবলি লিখিত ছিল । পুন্ডুলিপিটির প্রতিটি পৃষ্ঠা খচ্চরের চামড়া দিয়ে তৈরি । ধরে নেওয়া হয় এর জন্য প্রায় ১৬০ টিরও বেশি চামড়া প্রয়োজন হয়েছে । বইটি ১৬৫ পাউন্ড ভারি  এবং ৮.৭ ইঞ্চি মোটা ।

তখনকার সময়ে বইয়ে বা শিল্পকর্মে  শয়তান বা তার অভিশপ্ত শিষ্যদের প্রতিকৃতির ব্যবহার করা বিরল কিছু ছিল না । কিন্তু কোডেক্স জিগাস এ ব্যবহার করা শয়তানের প্রতিকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের । এটিতে ব্যবহৃত শয়তানের ১৯ ইঞ্চি প্রতিকৃতিটি ছিল একা এবং খালি গায়ের । তবে এর পরনে মোটা উলের তৈরি রাজকীয় পোশাক আরমিন ছিল । যার মাধ্যমে তাকে নরকের রাজপুত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে ।

শয়তানের বাইবেল
কোডেক্স জিগাস এ ব্যবহার করা শয়তানের প্রতিকৃতি

ছবিটিতে শয়তানকে সামনের দিকে সমান্য ঝুঁকে থাকা অবস্থায় আঁকা হয়েছে । যার কারণে এর দিকে তাকালে মনে হয় শয়তান বুঝি হঠাৎ বই থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে ।

প্রচলিত কাহিনী অনুসারে বইটি লেখতে সময় লেগেছে মাত্র একটি রাত । কিন্তু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের মতে, একজন মানুষ যদি দিনরাত একটানা কাজ করে তবে ছবি বাদে শুধু পান্ডুলিপির লেখাটুকু লিখে শেষ করতে সময় লাগবে ৫ বছর । আর লেখক যদি দৈনিক ৬ ঘন্টা করে লেখেন তাহলেও বইটি শেষ করতে সময় লাগবে ত্রিশ বছর ! এখন প্রশ্ন হতে পারে হয়তো এটি অনেকে একসাথে মিলে লেখেছেন ।

আরো পড়তে পারেন

তবে আধুনিক হ্যান্ড রাইটিং এক্সপার্টরা বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমান করেছেন যে পান্ডুলিপিটি একজনের দ্বারাই লেখা হয়েছে ।

কোডেক্স জিগাস
কোডেক্স জিগাস এর ২৫৪ তম পৃষ্ঠা

কি আছে শয়তানের বাইবেলে

কোডেক্স জিগাস সম্পূর্ণ ল্যাটিন ভাষায় রচিত । এটি রচনায় লাল, নীল হলুদ, সোনালী এবং সবুজ রঙের কালি ব্যবহার করা হয় হয়েছে । এর মধ্যে রয়েছে ওল্ড টেস্টামেন্ট, ফ্ল্যাভিয়াস জোসেফাস নামক এক পণ্ডিত রচিত The Jewish War and Jewish Antiquities, ইসিডোর অফ সেভিলের লেখা এনসাইক্লোপিডিয়া এটিমোলজিয়া, যাজক কোমাক রচিত The Chronicle of Bohemia, থিওফিলাস, হিপ্পোক্রেটিস সহ বিভিন্ন লেখকদের লেখা কিছু চিকিৎসা বিদ্যা আরো রয়েছে বিভিন্ন জাদুবিদ্যা, ভূত ছাড়ানোর কৌশল সহ ইত্যাদি ।

সম্পূর্ণ পান্ডুলিপিতে মাত্র দুটি ছবি অঙ্কিত হয়েছে । একটি হলো লুসিফারের এবং অন্যটি হলো স্বর্গীয় শহর জেরুজালেমের । তবে স্বর্গীয় শহরের ছবিতে কোনো মানুষের ছবি আঁকা হয়নি। শহরটি জনমানবশূন্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

কোডেক্স জিগাস
কোডেক্স জিগাস এ ব্যবহৃত স্বর্গীয় শহর জেরুজালেম

পান্ডুলিপিটির বাইবেল রাজাবলির সূচনায় বড়ো হাতের অক্ষরগুলি বিভিন্ন রঙে বিস্তারিত ভাবে অলংকৃত করা হয়েছে । এতে রয়েছে জোসেফাসের একটি লেখক প্রতিকৃতি এবং একটি আদ্যক্ষরের উপর একটি কাঠবিড়ালির ছবি । মানুষ বা পশুপাখির ছবির পরিবর্তে এটিকে অলংকরনের ক্ষেত্রে জ্যামিতিক চিত্র বা গাছপালার ছবি আঁকা হয়েছে ।

আরো পড়তে পারেন

বর্তমানে এটি কোথায় আছে ?

শুরুতে এটি বোহেমিয়ার মঠেই ছিল । পরে আর্থিক দেনা মেটাতে বোহেমিয়ার মঠ কর্তৃপক্ষ পান্ডুলিপিটি অন্য একটি মঠে বন্ধক রাখেন । ১৫৯৪ সাল পর্যন্ত এটি চেক প্রজাতন্ত্রের শহর শ্রুদিমের একটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত ছিল । কিন্তু ঘনটাক্রমে এটি  ১৫৯৪ সালে হাঙ্গেরির রাজা দ্বিতীয় রুডলফের হাতে আসে । তিনি এটিকে প্রাগের সাম্রাজ্যিক গ্রন্থাগারে স্থান দেন । কিন্তু ১৬৪৯ সালে সুইডেন সেনাবাহিনী যুদ্ধ জয় করে অন্য সব জিনিসের মতো এটিও হাঙ্গেরি থেকে নিয়ে আসে সুইডেনে ।

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৩৫৯ বছর পরে এটি সুইডেন থেকে ফের হাঙ্গেরিতে ফিরে যায় । তবে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে এটি পুনরায় সুইডেনে ফিরে আসে । সেই থেকে আজ পর্যন্ত এটি সুইডেনের মিউজিয়ামেই রয়েছে ।

ডেভিলস বাইবেল

যে যুক্তিততে কোডেক্স জিগাস কে শয়তানের বাইবেল বলা হয় । হয় তো সেটি সঠিক নয় । ভারতের দশরথ মাঝি ২২ বছর ধরে একাই পাহাড় কেটে গ্রামবাসীর জন্য রাস্তা তৈরি করে । হয় তো এমন কোনো মানুষই দীর্ঘ ২০ -৩০ বছর যাবৎ কঠোর পরিশ্রম করে কোডেক্স জিগাস নামক এই পান্ডুলিপিটি রচনা করেন । কারণ মানুষের অসাধ্য বলতে কিছুই নেই । 

আশা করি আপনার ভালো লেগেছে । ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ রইলো । এছাড়াও আরো কিছু সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে প্রশ্ন করলে আমার আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো ।

আরো পড়তে পারেন

বীজগণিতের সূত্র সমূহ

মোবাইল ভালো রাখার উপায়

ব্লগ তৈরির নিয়ম : ২০২২

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন