পৃথিবীতে শুধু মাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষার জন্য মানুষ তার জীবন উৎসর্গ করেছে এমন একটিও উদাহরণ নেই। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় হলো আজকে আমরা যে দিকে তাকাই সেদিকেই ইচ্ছা বা অনিচ্ছা করে বাংলা ভাষার হাজার হাজর ভুল পরিলক্ষিত হয়। আমরা প্রত্যেকের জায়গা থেকে কিছুটা সচতেন হলে এই সকল ভুলগুলো এড়ানো যেত।
বানান শুদ্ধিকরণ |
চাকরিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বানান শুদ্ধিকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিক বিবেচনা করে সরাসরি হ্যান্ডনোট থেকে সংকলিত করে এই আর্টিকেলে সহজ ভাবে বাংলা বানান শুদ্ধিকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি প্রত্যেকের কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। সঠিক ভাবে বাংলা বানান লিখার জন্য এখানে ঘুরে আসতে পারেন।
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ১
বিশেষণ এর সাথে তা/য যোগ করলে সেটি বিশেষ্য হয়ে যাবে। অর্থ্যাৎ একটি শব্দ যদি বিশেষণ হয় তবে সেটাকে দুই ভাবে বিশেষ্য - এ রূপান্তর করা যায়।
১. তা প্রত্যয় যুক্ত করে
অথবা
২. য প্রত্যয় যুক্ত করে
বিশেষণ নির্ণয়ের কৌশল
এখন কোন একটি শব্দ বিশেষণ
কি না সেটা বোঝার জন্য প্রথমে শব্দটি দিয়ে বাক্য তৈরি করতে হবে। এরপর "কেমন"
বা "কি" দিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। যদি "কেমন" দিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর
পাওয়া যায় তবে সেটি বিশেষণ এবং কি দিয়ে প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া গেলে সেটা বিশেষ্য।
✔✔ উদাহরণ:
লোকটি দরিদ্র
লোকটি কেমন? উত্তর হলো
দরিদ্র
তা প্রত্য়য় যুক্ত করার নিয়ম
তা প্রত্যয় যুক্ত হলে আদিস্বরের
কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন:
✔✔ দরিদ্র+তা ➡ দরিদ্রতা
য প্রত্য়য় যুক্ত করার নিয়ম
য প্রত্য়য় যুক্ত হলে আদিস্বর বৃদ্ধি পায় বা পরিবর্তন হয়। যেমন:
✔✔ দরিদ্র+য ➡ দারিদ্র্য
আদিস্বর নির্ণয় করার নিয়ম
দরিদ্র শব্দটির প্রথম বর্ণ "দ" অর্থ্যাৎ এখানে "দ" হলো আদিস্বর। "দ" এর সাথে কোনে কার নেই। কার নেই মানে"দ" এর সাথে "অ" আছে। নিয়ম অনুসারে "অ" থাকলে "আ" হয়। যেমন: দরিদ্র+য ➡ দারিদ্র্য।
আদিস্বর বৃদ্ধির নিয়ম
১. আদিস্বরে অ থাকলে আ হয়। যেমন: দরিদ্র+য ➡ দারিদ্র্য
২. আদিস্বরে ই/ঈ থাকলে এ/ঐ হয়। যেমন: বিশিষ্ট+য ➡ বৈশিষ্ট্য
৩. আদিস্বরে উ/ঊ থাকলে ও/ঔ হয়। যেমন: সুজন+য ➡ সৌজন্য
৪. আদিস্বরে ঋ থাকলে অর/আর হয়। যেমন: কৃপন+য ➡ কার্পন্য
নোট: "য" টা
(্য) ফলা হিসেবে বসে।
নিচের কোনটি সঠিক
ক. দরিদ্র্য [ এখানে
"্য" ফলা আছে কিন্তু আদিস্বর বৃদ্ধি পায় নি তাই এটি ভুল ]
খ. দারিদ্র [ এখানে আদিস্বর
বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শেষে "্য" ফলা নেই তাই এটি ভুল ]
গ. দরিদ্র্যতা [ এখানে
"্য" ফলা এবং "তা" প্রত্যয় একসাথে ব্যবহার করা হয়েছে তাই এটি ভুল
]
ঘ. দারিদ্রতা [ শেষে
"তা" প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে এবং আদিস্বর বৃদ্ধি পেয়েছে তাই এটিও ভুল ]
✔✔ সঠিক হলো ➡ দরিদ্র/দরিদ্রতা/দারিদ্র্য
আরো পড়তে পারেন
বোঝার জন্য আরো কিছু উদাহরণ
দেওয়া হলো
✔✔ দীন+তা ➡ দীনতা
দীন+য➡ দৈন্য
✔✔ স্বতন্ত্র+তা ➡ স্বতন্ত্রতা
সতন্ত্র+য ➡ স্বাতন্ত্র্য
✔✔ সম+তা ➡ সমতা
সম+য ➡ সাম্য
✔✔ বিচিত্র+তা ➡ বিচিত্রতা
বিচিত্র+য ➡ বৈচিত্র্য
✔✔ বিশিষ্ট+তা ➡ বিশিষ্টতা
বিশিষ্ট+য ➡ বৈশিষ্ট্য
✔✔ কৃপন+তা ➡ কৃপনতা
কৃপন+য ➡ কার্পন্য
✔✔ সুজন+তা ➡ সুজনতা [ বাংলা ভাষায় এটার প্রয়োগ কম ]
সুজন+য ➡ সৌজন্য
✔✔ সুন্দর + তা ➡ সুন্দরতা [ বাংলা ভাষায় এটার প্রয়োগ কম ]
সুন্দর+য ➡ সৌন্দর্য [ "র" এর সাথে "য" যুক্ত হলে "য" হয়ে যায় মুক্ত এবং "র" হয়ে যায় রেফ ]
✔✔ গম্ভীর + তা ➡ গম্ভীরতা
গম্ভীর+য ➡ গাম্ভীর্য
✔✔ মধুর+তা ➡ মধুরতা
মধুর+য ➡ মাধুর্য
✔✔ প্রচুর+তা ➡ প্রচুরতা
প্রচুর+য ➡ প্রাচুর্য
✔✔ এক+তা ➡ একতা
এক+য ➡ ঐক্য
✔✔ অলস+তা ➡ অলসতা
অলস+য ➡ আলস্য
✔✔ বহুল+তা ➡ বহুলতা
বহুল+য ➡ বাহুল্য
✔✔ উল্লেখ্য ➡ এই নিয়ম শুধু বানান শুদ্ধিকরণেই সাহায্য করবে না। এছাড়াও এই নিয়মের মাধ্যমে প্রত্য়য়, পদ বাক্যশুদ্ধি ও নির্ণয় করা যাবে। যেমন:
ক. প্রত্য়য়: দরিদ্রতা শব্দের
প্রকৃতি-প্রত্য়য় কোনটি? উত্তর: দরিদ্র+তা
খ. পদ নির্ণয়: কোনটি কোন
পদ এটা নির্ণয় করা যাবে। যেমন: সৌন্দর্য কোন পদ?
গ. বাক্যশুদ্ধি: দৈন্যতা
সর্বদা মহত্ত্বের পরিচায়ক নয় বাক্যটির শুদ্ধরূপ লেখ
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ২
অ-তৎসম শব্দে ণ/ষ/ঈ/ঊ/ূ কার /ঋ/ৃ কার এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। ব্যবহার করতে হবে ন/স/ই/ি কার/উ/ু কার
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. দুরবীণ
খ. দূরবীণ
গ. দূরবিন
ঘ. দুরবিন
✔✔ সঠিক উত্তর : দুরবিন
কারণ "দুরবিন"
ফারসি শব্দ মানে এটা বিদেশি শব্দ অর্থ্যাৎ অ-তৎসম শব্দ। আর অ-তৎসম শব্দে "ূ"
কার, " ী" কার এবং "ণ" বসে না।
আরো কিছু উদাহরণ
১. "কাহিনি"
এটি হিন্দি শব্দ তাই "কাহিনী" হবে না।
২. "বিরিয়ানি"
এটা ফারসি শব্দ তাই "বিরিয়ানী" হবে না।
৩. "চব্বিশ পরগনা"
ফারসি শব্দ তাই "চব্বিশ পরগণা" হবে না।
৪. "পরান" অর্ধ
তৎসম শব্দ তাই "পরাণ" হবে না।
৫. "দরুন" ফারসি
শব্দ তাই "দরুণ" হবে না।
৬. কোরআন, কোরবানি আরবি
শব্দ তাই এগুলোতে "ণ" হবে না।
এছাড়াও শিহরন, কেরানি,
ঝরনা/ঝর্না, চিরুনি এগুলো বাংলা শব্দ "ণ" হবে না।
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৩
যে সব শব্দের অর্থ আছে তাদের শেষে "স্থ" যুক্ত হয়। যেমন:
✔✔ ঠোঁট+স্থ ➡ ঠোঁটস্থ
✔✔ মুখ+স্থ ➡ মুখস্ত
✔✔ অসু+স্থ ➡ অসুস্থ [ অসু শব্দের অর্থ প্রান ]
যে সব শব্দের অর্থ নেই সেগুলোর শেষে "স্ত" হয়। যেমন:
✔✔ নেশাগ্র+স্ত ➡ নেশাগ্রস্ত [ এখানে "নেশাগ্র" এর অর্থ নেই ]
ব্যতিক্রম : বিশ্বস্ত যদিও
বিশ্ব শব্দের অর্থ আছে, তারপরেও স্ত বসেছে ]
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৪
উনিশ, উনত্রিশ, উনচল্লিশ, উনপঞ্চাশ, উনষাট, উনসত্তর, উনআশি, উননব্বই, এগুলো বাংলা শব্দ তাই "উ" দিয়ে লিখতে হবে। অন্যদিকে এগুলোর ক্রমবাচক শব্দ "ঊ" দিয়ে লিখতে হবে।
✔✔ যেমন: ঊনবিংশ, ঊনত্রিংশ
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৫
অঞ্জলি, আবলি, আলি, ইক কোনো শব্দে এ প্রত্য়য়গুলো যুক্ত হলে "ি" কার হয়। যেমন:
অঞ্জলি | আবলি | আলি | ইক |
---|---|---|---|
জলাঞ্জলি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রেমাঞ্জলি গীতাঞ্জলি পুষ্পাঞ্জলি |
কার্যাবলি রচনাবলি বিষয়াবলি নিয়মাবালি শর্তাবলি |
সোনালি রূপালি মিতালি বর্ণালি খেয়ালি |
দৈনিক ব্যাবহারিক ভৌগলিক |
✔✔ বি:দ্র: রূপালী ব্যাংক,
সোনালী ব্যাংক এগুলো নাম তাই উক্ত বানান গুলোই সঠিক।
নোট:
ক. ইক প্রত্যয় যুক্ত
শব্দটি বিশেষণ হয়।
খ. ইক প্রত্য়য় যুক্ত হলে
আদিস্বর বৃদ্ধি পায়।
গ. ইক প্রত্য়য় যুক্ত হলে
"ি" কার হয়।
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৬
কোনো শব্দের শেষে "ঈ" কার থাকলে তা/ত্ব/নী/সভা/পরিষদ/জগৎ এগুলো যুক্ত হলে শব্দের শেষের "ঈ" কারটি "ই" কার হয়ে যাবে। যেমন:a
✔✔ তা
প্রতিযোগী+তা ➡ প্রতিযোগিতা
সহযোগী+তা ➡ সহযোগিতা
সহমর্মী+তা ➡ সহমর্মিতা
✔✔ নী
প্রণয়ী+ণী ➡ প্রণয়িনী
সহযোগী+নী ➡ সহযোগিনী
অনুগামী+নী ➡ অনুগামিনী
✔✔ ত্ব
অধিকারী+ত্ব ➡ অধিকারিত্ব
একাকী+ত্ব ➡ একাকিত্ব
দায়ী+ত্ব ➡ দায়িত্ব
স্থায়ী+ত্ব ➡ স্থায়িত্ব
মন্ত্রী+সভা ➡ মন্ত্রিসভা
✔✔ সভা
মন্ত্রী + সভা ➡ মন্ত্রিসভা
✔✔ পরিষদ
মন্ত্রী+পরিষদ ➡ মন্ত্রিপরিষদ
✔✔ জগৎ
প্রাণী+জগৎ ➡ প্রণিজগৎ
✔✔ ব্যতিক্রম: নারী+ত্ব ➡ নারীত্ব
কুমারী+ত্ব ➡ কুমারীত্ব
সতী+ত্ব ➡ সতীত্ব
বাংলা বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৭
পূর্বপদের পরে (-করণ,
-কৃত, ভবন, -ভূত) যুক্ত করলে নতুন করে "ঈ" কার হয়। যেমন:
✔✔ আত্ম+করণ ➡ আত্মীকরণ
✔✔ আত্ম+কৃত ➡ আত্মীকৃত
✔✔ একত্র +ভূত ➡ একত্রীভূত
✔✔ পুঞ্জ+ভবন ➡ পুঞ্জীভবন
✔✔ শুদ্ধ + করণ = শুদ্ধীকরণ
✔✔ বাষ্প + করণ ➡ বাষ্পীকরণ
বাংলা বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৮
বিশেষ্যের সাথে "ঈ" প্রত্য়য় যুক্ত করলে বিশেষণ গঠিত হয়। যেমন:
✔✔ অপরাধ হতে অপররাধী
✔✔ গুণ হতে গুণী
✔✔ দোষ হতে দোষী
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ৯
শব্দের অর্থ দূরত্ব বুঝালে "ঊ" কার হয়। অন্যথায় "উ" কার হয়। যেমন:
দূর, দূরীভূত, দূরদর্শন,
দূরীকরণ এবং দুর্ঘটনা, দুর্বিষহ, দুর্ভোগ ইত্যাদি
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ১০
শুধুমাত্র অদ্ভুত শব্দে "উ" কার হবে। অন্যক্ষেত্রে "ভূ" লেখতে "ঊ" কার হবে।
বানান শুদ্ধিকরণ নিয়ম ১১
নিচের শব্দগুলোতে "হ্স" চিহ্ন দিতে হবে। অন্যথায় ভুল হবে।
উদ্ঘাটন, উদ্বেগ, উদ্ভ্রান্ত, উদ্যাপন, দিক্পাল, দিক্ভ্রম, দিক্দর্শন, প্রাক্-কথন, বাক্-সর্বস্ব ইত্যাদি
আমাদের শেষ কথা
আমরা গর্বিত আমরা বাঙালী। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তাই ভাষার সঠিক প্রয়োগ প্রত্যেক বাঙালীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। আশা করি আপনার দৈনিন্দিন ব্যবহারে বানান শুদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করছি।
আরো পড়তে পারেন