বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন কিন্তু আমরা সেই ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কোনো চেষ্টা করি না। স্কুল কলেজের গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমরা শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার যোগ্যতা লাভ করতে পারছি না। ফলে বাংলা ভাষা শুধু একটু আন্তরিকতার অভাবে ক্রমেই চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। 

এ বিপর্যয়ের দায় আমরা এড়াতে পারব না। ভুল বানানে লেখা সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন দেখে এখন আর কেউ অবাক হন বলে মনে হয়। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লগ, ফেসবুক, অনলাইন। নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব স্থানে যা খুশি তা লেখাটাই যেন রীতি! কিংবা এ ক্ষেত্রে বানান নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। শুধু তাদের কথাই-বা বলি কেন, প্রতিদিন যত পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে তার কষ্টার মধ্যে শুদ্ধ বাংলা বানান প্রয়োগের চেষ্টা থাকে?

বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ
এখন যা খুশি তা লেখাটাই যেন রীতি!

তাই আমরা আজ বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করবো। সেই সাথে সমাজে প্রচলিত বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ চিহ্নিত করে সেগুলোর শুদ্ধ প্রয়োগ দেখাব। যাতে করে লেখার ক্ষেত্রসহ জীবনের বিভিন্নক্ষেত্রে আমরা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করে বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ করতে পারি।

এছাড়াও এইচ.এস.সি সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ।

বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ

১. অত্র

"অত্র" শব্দের অর্থ এখানে 

‘তত্র’ সেখানে, ‘যত্র’ যেখানে, যত্রতত্র অর্থ যেখানে-সেখানে। অত্র কখনোই এই অর্থে ব্যবহার শুদ্ধ প্রয়োগ হতে পারে না। অথচ অফিস আদালতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, প্রতিবেদন ইত্যাদিতে অত্র শব্দটিকে এই অর্থ প্রকাশের বেলায় লেখা হয়। অত্র অফিস অর্থ এখানে অফিস এই অফিস নয়। কাজেই ‘এই’ অর্থে ‘অত্র’ যত্রতত্র যাতে ব্যবহার না করা হয়, সেদিকে ভাষা ব্যবহারকরীকে সতর্ক থাকতে হবে।

২. প্রেক্ষিত/পরিপেক্ষিত

পরিপেক্ষিত ও প্রেক্ষিত শব্দের অর্থ আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তবু অনেকে পরিপেক্ষিত বুঝাতে প্রেক্ষিত শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রেক্ষিত শব্দ হতে প্রেক্ষণ শব্দের উদ্ভব। এর অর্থ দৃষ্টি। প্রেক্ষিত হচ্ছে প্রেক্ষণ শব্দের বিশেষণ। এর অর্থ যা দর্শন করা হয়েছে। সুতরাং Perspective/Background শব্দের অর্থ বুঝাতে প্রেক্ষিত লেখা বড় ত্রুটি। এ অর্থে লেখুন পরিপ্রেক্ষিত।

৩. অনুষ্ঠেয়/অনুষ্ঠিতব্য

ভবিষ্যতে কোনো কিছু অনুষ্ঠিত হবে- এ অর্থ বুঝাতে অনেকে অনুষ্ঠিতব্য শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। এটি ভুল শব্দ, বাংলায় এমন কোনো শব্দ নেই। কর্তব্য বা করার উপযুক্ত অর্থে জ্ঞাতব্য, দাতব্য, কহতব্য, পঠিতব্য, ভবিতব্য ইত্যাদি শব্দগুলো বাংলা ভাষায় রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে মিল রেখেই হয়তো অনুষ্ঠিতব্য শব্দটি প্রচলিত হয়ে গেছ। ভবিষ্যতে কোনো কিছু অনুষ্ঠিত হবে- অর্থে অনুষ্ঠেয় শব্দটি ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়।

৪. সহসা

সহসা তৎসম শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হঠাৎ/ অকস্মাৎ/ অতর্কতিভাবে। সহসা শব্দটি অনেকে শীঘ্র, তাড়াতাড়ি, সত্বর, খুব একটা সাধারণত অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। ‘সহসা বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা নেই’ অর্থ ‘অতর্কতিভাবে বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা নেই’। সুতরাং শীঘ্র, তাড়াতাড়ি অর্থে সহসা ব্যবহার করা ভুল।

আরো পড়তে পারেন

৫. ফলশ্রুতি/ফল

ফলশ্রুতি শব্দের আভিধানিক অর্থ পুণ্যকর্মের বিবরণ শ্রবণ। বর্তমানে যেভাবে Consequence অর্থে ফলশ্রুতি ব্যবহার করা হয় তা সঠিক নয়। এর পরবর্তে লিখুন ফল, ফলাফল, পরিণতি বা পরিণাম

৬. ভারি/ভারী

‘ভারি' ও ‘ভারী' এক শব্দ নয়। ই-কার কিংবা দীর্ঘ-ইকার লিখতে ভুল হলে পুরো বাক্যের অর্থ উল্টোপাল্টা হয়ে যাবে অতি/ অত্যন্ত/ দারুণ (Very) অর্থে ভারি' শব্দ ব্যবহার করুন যেমন: ভারি সুন্দর গ্রাম। অন্যদিকে 'গুরুভার/ দায়িত্বভার দায়িত্বপূর্ণ' (Heavy, Weighty) অর্থে 'ভারী' শব্দটি ব্যবহার করুন। যেমন: এত ভারী দায়িত্ব পালন আমার পক্ষে কষ্টকর হবে। বোঝাটা খুব ভারী।

৭. উল্লেখিত/ উল্লিখিত

বাংলা ব্যাকরণের নিয়মানুসারে উল্লেখিত শব্দটি অশুদ্ধ। অভিধানে এরূপ কোনো শব্দ নেই। শব্দটি হচ্ছে উৎ + লিখিত = উল্লিখিত। উৎ শব্দের অর্থ উপরে/ পূর্বে এবং লিখিত শব্দের অর্থ যা লেখা হয়েছে। সুতরাং উল্লিখিত শব্দের অর্থ যা উপরে বা পূর্বে লেখা হয়েছে। আর যেটা উল্লেখ (Mention) করা হয়েছে বোঝাতে লিখুন উল্লেখকৃত বা উপর্যুক্ত। অনেকেই উপরোক্ত লিখে থাকেন তা ভুল। পরি-উপসর্গের সঙ্গে অ আ ই উ ধ্বনির সন্ধি ঘটলে য-য়ে রেফ হয়। যেমন: উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মহোদয়ের সদয় জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, ... । এছাড়াও আছে উপর্যুপরি ।

৮. শয়িত/ শায়িত

শয়িত' শব্দের অর্থ ‘শুয়েছে বা নিদ্রিত। শায়িত' শব্দের অর্থ যাকে শোয়ানো হয়েছে বা শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা নিদ্রিত/শুয়েছে বুঝাতে লিখে থাকি বিছানায় কেউ শায়িত আছেন'। এটি ভুল। এটা হবে বিছানায় কেউ শয়িত আছেন

(৯) ব্যবহার/ ব্যবহৃত

'ব্যবহার' ও 'ব্যবহৃত' শব্দ দুটিকে প্রায়শ ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন: এখন আর গ্রামদেশে গরুর গাড়ি ব্যবহার হয় না। এটা ভুল। ব্যবহার' শব্দের সঙ্গে করা এবং ব্যবহৃত শব্দের পর হওয়া ক্রিয়াপদ যুক্ত থাকা আবশ্যক। একইভাবে উৎপাদন' শব্দটি বিশেষ্য কিছু শব্দটির পরে করা শব্দ বসালে ক্রিয়াপদে পরিণত হয়। যেমন: এ বছর চিনির উৎপাদন অনেক কম। আর উৎপাদিত শব্দটি বিশেষণ। যেমন: সুইজারল্যান্ডে উৎপাদিত ঘড়ি মজবুত ও টেকসই। মিলে লবণ উৎপাদন হচ্ছে বাক্যটি শুদ্ধ নয়। লিখতে হবে 'মিলে লবণ উৎপাদন করা হচ্ছে কিংবা মিলে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে।

১০. প্রচার প্রচারণা

প্রচার ও প্রচারণা শব্দের অর্থ প্রায় অভিন্ন হলেও বাংলা ভাষায় এর প্রায়োগিক ক্ষেত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। শুভ উদ্দেশ্যে সত্য/কল্যাণকর কোনো কিছু জনগণের গোচরে আনার অর্থ হচ্ছে 'প্রচার'। পক্ষান্তরে অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের কাছে মিথ্যা/অকল্যাণকর কিংবা অশুভ কিছু প্রকাশ করা হচ্ছে 'প্রচারণা'।

১১. এক রকম/ একরকম

'এক রকম' এবং 'একরকম ভিন্ন অর্থের শব্দ। এক রকম, এর অর্থ একই প্রকার যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Same type / Same Kind. যেমন: তারা দু' বোন দেখতে এক রকম। কিন্তু “একরকম' শব্দের অর্থ প্রায়/মোটামুটি। যেমন: এই আছি একরকম।

১২. নয় তো/ নয়তো

বাক্যে হ্যাঁ-বাচক ও প্রশ্নের ইঙ্গিতবাহী অর্থ প্রকাশে 'নয় তো’ ব্যবহার করা হয়। যেমন: গ্লাসটা দুলাল 'নয় তো' কে ভাঙবে? অন্যদিকে বিকল্প প্রকাশে নয়তো শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন: আগামীকাল ‘নয়তো' পরশু এসো।

আরো পড়তে পারেন

১৩. অধস্তন/ অধঃস্তন

অধঃ+তন = অধস্তন। এর অর্থ নিম্নপদস্থ। সন্ধির নিয়মানুসারে বিসর্গ উঠে গিয়ে 'স' বসেছে। অনেকে 'অধস্তন' বানানকে 'অধঃস্তন হিসেবে লিখে থাকেন। তবে 'অধঃস্তন' শব্দের অর্থ হচ্ছে নিচের স্তন/নিম্নস্থ স্তন।।

১৪. তাই/তা-ই

“তাই” শব্দের সমার্থক হচ্ছে- সুতরাং, অতএব, সেজন্য, সেহেতু, সেকারণে। যেমন: সকালে খাও নি, তাই খিদে লেগেছে। আর 'তা-ই' শব্দের সমার্থক হচ্ছে সাধু ভাষার তাহাই। যেমন: যা চাইছি তা-ই দিতে হবে।

১৫. অনুগত বাধ্যগত

‘বাধ্যগত' বলে কোনো শব্দ বাংলাতে নেই। অথচ আমরা সবাই ছোটবেলায় লিখেছি, আপনার একান্ত বাধ্যগত ছাত্র। কিন্তু অনুগত' শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে বাধ্যগত লেখা ভুল।

'অনুগমন' শব্দ হতে অনুগত' শব্দের উৎপত্তি। যিনি অনুগমন করেন তিনি অনুগত। সে হিসেবে যিনি বাধ্যগমন করে তিনি বাধ্যগামী। কিন্তু বাধ্যগমন' বলতে কোনো শব্দ যেহেতু বাংলা ভাষায় নেই, সেহেতু বাধ্যগত' শব্দটিও নেই।

১৬. লজ্জাকর/ লজ্জাস্কর

লজ্জা + কর = লজ্জাকর। কিন্তু অনেকে লিখেন লজ্জাস্কর। কোনো নিয়মানুসারে 'লজ্জাস্কর' লেখা হয় তা বোধগম্য নয়। তবে তেজস্কর, যশস্কর, কিয়স্কর, দুষ্কর ইত্যাদি শব্দের অনুকরণে হয়তো এর প্রচলন হয়েছে।

রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি ইত্যাদি নীতির সাথে জড়িত, নৈতিকতার সাথে নয়। তাছাড়া শব্দের শেষে ইক প্রত্যয় যুক্ত হলে শব্দের প্রথম বর্ণে পরিবর্তন হয়, মধ্যে হয় না। যেমন: ইতিহাস-ঐতিহাসিক। একইভাবে বর্ষ হতে বার্ষিক, সময় হতে সাময়িক, সুতরাং সমসময় হতে সামসময়িক। সুতরাং সমসাময়িক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক প্রভৃতি ভুল শব্দ। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার এত বেশি যে, ভাষাবিদরা তা অভিধানে অনেকসময় ঠাই দিলেও সেগুলোকে প্রচলিত ভুল, অপপ্রয়োগ মনে করেন। এমনটি লেখা উচিত নয় ।

১৭. দাঁড়িয়েছিল, দাঁড়িয়ে ছিল

দাঁড়িয়েছিল শব্দর অর্থ Stood, কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল শব্দের অর্থ was standing/had been standing/remained standing. দাঁড়িয়েছিল, শুয়েছিল, বসেছিল, খেয়েছিল ক্রিয়াপদগুলো দিয়ে নিত্য অতীত কিংবা সাধারণ অতীত বুঝানো হয়। কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল, শুয়ে ছিল, বসে ছিল ইত্যাদি ক্রিয়াপদ দ্বারা ঘটমান অতীত কাল বুঝানো হয়।

১৮. কৃতদাস/ ক্রীতদাস

কৃতদাস শব্দের অর্থ দাসত্বে আবদ্ধ কিংবা দাসে পরিণত। এ শব্দটির ব্যবহার সচরাচর হয় না। পক্ষান্তরে ক্রীতদাস শব্দের অর্থ এমন একজন ব্যক্তি যাকে সারা জীবনের জন্য দাসরূপে ক্রয় করা হয়েছে।

১৯. লক্ষ/ লক্ষ্য

'লক্ষ' ও 'লক্ষ্য' এর ব্যবহারে অনেকেরই ভুল হয়ে থাকে। অঙ্ক বা সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে 'লক্ষ' ব্যবহার করা হয়। আবার খেয়াল রাখা প্রকাশেও 'লক্ষ' বা 'লক্ষণীয় ব্যবহার করা হয়। বিশেষ্য পদ ‘উদ্দেশ্য' অর্থে ব্যবহার করা হলে 'লক্ষ্য' বানানে *য-ফলা ব্যবহার করতে হয়। তাই উদ্দেশ্যচ্যুত অর্থে 'লক্ষ্যভ্রষ্ট' ব্যবহার করতে হবে। তবে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে য-ফলা ব্যবহার বিধেয় নয়। উদাহরণ: সত্যপ্রতিষ্ঠাই আমার জীবনের লক্ষ্য। কখন নেতা কী আদেশ দেন সেদিকে লক্ষ রাখবে।

২০. সাল / খ্রিস্টাব্দ

'সাল' শব্দের অর্থ বছর বা Year, খ্রিস্টাব্দ শব্দের অর্থ AD (Anno Domini); সহজ বাংলায় বলা যায় যিশুখ্রিস্টের পরে। রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১ সালে/সনে জন্মগ্রহণ করেছেন বাক্যটির অর্থ হচ্ছে - রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ বছরে/বর্ষে জন্মগ্রহণ করেছেন। এটি হাস্যকর নয় কি? কাজেই 'সাল' এবং 'খ্রিস্টাব্দ দুটি ভিন্নার্থক শব্দ। ১২০০ বঙ্গাব্দ বুঝাতে যেমন 'সাল' লেখা উচিত নয়, তেমনি উচিত নয় ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ বুঝাতে 'সাল' লেখা। লিখুন। ১২০০ বঙ্গাব্দ, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ, ১২০০ হিজরি, ১০০০ মঘি, ১৩০০ শকাব্দ ইত্যাদি ।

২১. মূর্ধন্য-ণ

"মূর্ধন্য 'ণ' কিন্তু দন্ত্য-'ম' দিয়ে লিখতে হয়। এটি ণত্ব বিধানের সূত্র। আমরা জানি র, ঋ এবং ষ ধ্বনির পরবর্তী দন্ত্য-'ন' সাধারণত: মূর্ধন্য 'ণ' হয়ে যায়। তাহলে দর্শন, অর্চনা, প্রার্থনা, কোরান, বর্জন, অর্জন ইত্যাদি বানানে দন্ত্য-ন কেন? কারন- র, ঋ এবং ষ ধ্বনির মাঝখানে যদি চ ট ও ত বর্গের ধ্বনি কিংবা ল, শ, স, ড় এবং ঢ় ধ্বনিগুলোর যে কোনো একটি থাকে তাহলে মূর্ধন্য-ণ পরিবর্তন হয়ে দন্ত্য-ন হয়ে যায়।

২২. কি/কী

কি প্রশ্নবোধক অব্যয়। যে সকল প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' বলে দেওয়া যায় সে সকল প্রশ্নবোধক বাক্যে কি লিখবেন। উদাহরণঃ আমি কি ভুল করেছি? (Have I made a mistake?) যে প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' দিয়ে বলা সম্ভব নয় সে সকল প্রশ্নবোধক বাক্যে 'কী' লিখবেন।

উদাহরণ: আমি কী ভুল করেছি? (What mistake have I made?)। 'কী' শব্দের আর একটি ব্যবহার হচ্ছে আশ্চর্যবোধক বাক্যে যেমন: বাহ, কী চমৎকার দৃশ্য। কোনটি, কোনভাবে, কোনগুলো প্রভৃতি বুঝালে 'কী' লিখতে হয়। 'কিভাবে' বানানটি ভুল। কারণ এ শব্দযুক্ত বাক্যের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' বলে দেওয়া যায় না। তাই লিখবেন 'কীভাবে' কখনও 'কিভাবে' লিখবেন না

২৩. বাল্ব/ ভাল্‌ভ /ভাল্ব

'বাল্ব' এবং 'ভাল্ভ' ইংরেজি শব্দ কিন্তু 'ভাল্ব' হচ্ছে প্রথমোক্ত শব্দ দুটির ভুল বানান। বাল্ব শব্দের অর্থ কন্দ বা গুটিকা। বিদ্যুতের আলো যে যন্ত্র হতে বের হয় সে যন্ত্রটি দেখতে কন্দ বা গুটিকার মত বলে এটাকে 'বাল্ব' (Bulb) বলা হয়। অন্যদিকে ‘ভাল্ভ' শব্দের অর্থ এমন একটি কপাট যা আগমন-নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন: হৃৎপিণ্ডের 'ভাল্ভ' (Heart valve)। সুতরাং বিদ্যুতের বাল্ব কে হৃৎপিণ্ডের ‘ভাল্ভ' করা অনুচিত।

আরো পড়তে পারেন

২৪. মুখপত্র / মুখপাত্র

'মুখপত্র' বলতে সংস্থাবিশেষের ইস্তাহার বা প্রচারপত্র বুঝানো হয়। যেমন: দৈনিক বজ্রকন্ঠ ছিল সরকারের মুখপত্র। 'মুখপাত্র' শব্দের অর্থ প্রতিনিধি। যেমন: তিনি বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছেন।

২৫. সঙ্গে / সাথে, মাঝে মধ্যে

*মাঝে' ও 'মধ্যে' দুটি শব্দের অর্থ অভিন্ন। তবে চিঠিপত্র কিংবা গদ্য রচনায় 'মাঝে' ব্যবহার না করে মধ্যে ব্যবহার করা উচিত তেমনি 'সঙ্গে' ও 'সাথে' শব্দের অর্থ অভিন্ন হলেও গদ্য রচনায় "সাথে' শব্দের ব্যবহার শ্রুতিকটু।

২৬. সাযুজ্য / সাদৃশ্য

'সাযুজ্য' বিশেষ্য পদ। এর অর্থ সহযোগ, অভেদ বা সমরূপ। উদাহরণ: প্রধান অতিথির বক্তৃতার সাথে সভাপতির বক্তব্যের 'সাযুজ্য' ছিল না। অন্যদিকে অনুরূপতা, সমতা বা তুল্য বুঝাতে 'সাদৃশ্য' শব্দ ব্যবহার করতে হয়। উদাহরণ: বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে কলকাতার সংস্কৃতির সাদৃশ্য রয়েছে। এখানে 'সাযুজ্য' লেখা ভুল।

২৭. Judicial Magistrate

উল্লিখিত শব্দদ্বয়কে বাংলায় লেখা হয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট যার বাংলা বিচারিক হাকিম। Judicial Magistrate শব্দদ্বয়কে বাংলায় জুডিশিয়াল লিখলে 'শিয়াল' শব্দটি অশোভন দেখায়। এজন্য এ জাতীয় বানানগুলো জুডিশাল / জুডিশ্যাল ম্যাজিস্ট্রেট লেখা শোভনীয়

২৮. বানান/ বানানো

'আনান আনানো / বানান-বনানো/ করান-করানো/ বলান - বলানো প্রতিটি শব্দ জোড়ার প্রথম শব্দের বানান 'ও-কার' বর্জিত, কিন্তু দ্বিতীয় শব্দ 'ও-কার' যুক্ত। শব্দগুলোর বানানে যেমন ভিন্নতা আছে তেমনি ভিন্নতা আছে অর্থে। ও-কার' বিহীন শব্দগুলো ক্রিয়াপদ কিন্তু 'ও-কার' যুক্ত শব্দগুলো বিশেষণ পদ। উদাহরণ: মা পিঠা বানান। খেলনাটি চায়নায় বানানো।

২৯. গড্ডলিক/ গড্ডালিকা

'গড্ড' শব্দের অর্থ ভেড়া এবং 'গড্ডলিকা' শব্দের অর্থ ভেড়ার মত অন্ধ অনুকরণ। অনেকে ভুল করে লিখেন 'গড্ডালিকা'।

৩০. বান/ মান

বিশেষ্য পদের সঙ্গে 'বান/মান' যুক্ত করে বিশেষণ তৈরি করা হয়। তবে কোথায় বান বসবে কিংবা কোথায় মান বসবে এর একটি নিয়ম আছে। সূত্রটি হলো: বিশেষ্য পদের শেষে 'অ/আ' থাকলে বান বসবে কিন্তু ই/ঈ বা উ/ঊ থাকলে মান বসবে। যেমন: অ/আ: অর্থ>অর্থবান, ক্ষমতা> ক্ষমতাবান, চরিত্র>চরিত্রবান, দয়া>দয়াবান, প্রজ্ঞা>প্রজ্ঞাবান, পূণ্য> পূণ্যবান ।

৩১. ‘ঈ' বা 'আ' প্রত্যয়জনিত প্রচলিত ভুল

অনেকে সংস্কৃত ভাষার নিয়মানুসারে বাংলা ভাষার বিশেষ্য ও যুক্ত বিশেষণবাচক শব্দের সাথেও 'ঈ/আ' প্রত্যয় যুক্ত করে থাকেন। এটি বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী অসিদ্ধ। বাংলা সংস্কৃত ভাষার সকল নিয়ম অনুসরণ করে না, এর ব্যাকরণ অনেক ক্ষেত্রেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। অবশ্য এরূপ 'ঈ/বা -আ' প্রত্যয় যুক্ত করাটি এখন এমন বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে যে, শুদ্ধ করতে যাওয়া বড় বিড়ম্বনা (বিড়াম্বনা ভুল) যেমন: জন্মবার্ষিকী, বিবরণী, মহতী, শতাব্দী, মণ্ডলী, সংশোধনী, চঞ্চলা, চয়নিকা 'ণ'- প্রভৃতি ভুল ।

শুদ্ধ হবে: জন্মবার্ষিক, বিবরণ, মহৎ, শতাব্দ, মণ্ডল, সংশোধন, চঞ্চল, চয়নিক প্রভৃতি।

৩২. স্ত্রী-বাচক প্রত্যয়ের বাহুল্যজনিত ভুল

বাংলা ব্যাকরণের নিয়মানুসারে তৎসম পুরুষ-বাচক শব্দের শেষে স্ত্রী-বাচক 'ঈ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন: হেমাঙ্গ>হেমাঙ্গী, অর্ধাঙ্গ>অর্ধাঙ্গী, সিংহ > সিংহী, সৰ্প সৰ্পী, অভাগা> অভাগী, ননদ-ননদিনী প্রভৃতি। এরূপ শব্দের সঙ্গে পুনরায় স্ত্রী-বাচক -ঈ প্রত্যয় যুক্ত করে হেমাঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী, সিংহিনী, সৰ্পিনী, অভাগিনী প্রভৃতি লেখা বিধেয় নয়।

৩৩. প্রাইম মিনিস্টার - হ্যাজ নো জেন্ডার

পদবি বা পদ-মর্যাদা বুঝানোর জন্য স্ত্রী-বাচক শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। মনে রাখবেন পদবি কোনো জীব নয়, একটি ধারণামাত্র। তাই পদবি সর্বদা লিঙ্গহীন। অনেকে পদবিকে জীব মনে করে তার সাথে স্ত্রীবাচক শব্দ বসিয়ে দেন। এটি প্রচলিত ভুল যা প্রমিত বাংলায় বিধেয় নয়।

উদাহরণ: শিক্ষিকা নয়, শিক্ষক অধ্যাপিকা নয়, অধ্যাপক ডাক্তারনি নয়, ডাক্তার; অধ্যক্ষা নয়, অধ্যক্ষ ইত্যাদি।

৩৪. ও / এবং

'ও' শব্দটি আরবি-ফারসি শব্দ 'ওয়া' কিংবা চর্যাপদের 'ওহো' থেকে বাংলায় এসেছে। 'ও' শব্দ সংযোজক অব্যয়। দুটো শব্দকে সংযোজন করার জন্য ও ব্যবহার করা হয়। যেমন- ফুল ও ফল। ভালো ও মন্দ। আর 'এবং' এর জন্ম সংস্কৃততে। 'এবং' এর কাজ হলো বাক্য বা বাক্যাংশ সংযোজন করা। যেমন- সে বলল, আমি আগামী কাল সেখানে যাব এবং কাজটি করব। তাই দু'টো শব্দের মিলন ঘটাতে ও-কেই দরকার।

৩৫. তৎসম শব্দ এবং হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বর এর ব্যবহার

ক. সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী কোনো তৎসম শব্দে হ্রস্ব বা দীর্ঘ উভয় স্বরের ব্যবহার অভিধানমতে শুদ্ধ গণ্য হলে আধুনিক বাংলা প্রমিত বানানে সে সকল শব্দে শুধু হ্রস্ব স্বর ব্যবহার করা হবে; দীর্ঘ স্বর নয়। যেমন: ভঙ্গী নয় ভঙ্গি; শ্রেণী নয় শ্রেণি; সূচী নয় সূচি এবং ঊষা নয় উষা, ঊর্বর নয় উর্বর, অন্তরীক্ষ নয় অন্তরিক্ষ।

৩৬. যুক্তবর্ণের একটি সহজ সূত্র

যুক্তবর্ণ গঠনের সময় নাসিক্য বর্ণগুলো ঐ বর্গের অন্য বর্ণগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়, অন্য বর্গের সঙ্গে যুক্ত হয় না। যেমন:

ঙ : ক-বর্গের পূর্বে বসলে যুক্ত হবে। অন্য কোথাও বসবে না। যেমন- অঙ্ক, বঙ্গ, সঙ্গীত, রঙ্গ, সঙ্ঘ।

ঞ: চ-বর্গের পূর্বেই যুক্ত হবে, এখানে ন বা ণ এর প্রবেশাধিকার নেই। যেমন- ঝঞ্ঝা, চঞ্চল, সঞ্চার, মঞ্চ, লাঞ্ছিত।

ণ: ট-বর্গের পূর্বে মূর্ধন্য ণ অবশ্যই যুক্ত হবে। এখানেও ন, ঙ বা ঞ এর প্রবেশাধিকার নিষেধ। তবে বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে না।

ন : ত-বর্গের অন্যান্য অক্ষরের সাথে দন্ত্য-ন যুক্ত হবে এখানেও অন্যবর্গের কারো উপস্থিতি কাম্য নয়। যেমন- দস্ত, গন্তব্য, প্রান্ত, শান্ত, গ্রন্থ।

ম : প-বর্গের অন্যান্য অক্ষরের পূর্বে বসলে সর্বদাই যুক্ত হয়ে বসবে। যেমন- লম্ফ, কম্প, আরম্ভ, দম্ভ, সম্পূর্ণ।

আমাদের শেষ কথা

আশা করি আর্টিকেলটির মাধ্যমে বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ ও শুদ্ধ প্রয়োগ সম্পর্কে জেনে নিয়ে ভবিষ্যতে ভাষার ব্যবহারে সচেতন হবেন। ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দেওয়ার অনুরোধ করছি। আর কোনো প্রশ্ন জানার ইচ্ছা হলে আমাদেরকে প্রশ্ন করতে পারেন । আমরা চেষ্টা করবো যত দ্রুত সম্ভব আপনার প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে ।

আরো পড়তে পারেন

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন