বাক্য কাকে বলে বাক্যের শ্রেণীবিভাগ উদাহরণসহ বিস্তারিত

কতকগুলো পদের সমষ্টিতে বাক্য গঠিত হলেও যে কোনো পদসমষ্টিই বাক্য নয়। বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকা আবশ্যক। এ ছাড়াও বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদ দ্বারা মিলিতভাবে একটি অখণ্ড ভাব পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন, তবেই তা বাক্য হবে। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক বাক্য কাকে বলে?

বাক্য কাকে বলে
বাক্য কাকে বলে

বাক্য কাকে বলে

যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে । English Grammar এ বাক্যকে Sentence বলে।

ব্যাকরণবিদ জ্যোতিভূষণ চাকী বলেন, যথাযথ বিন্যস্ত শব্দসমষ্টি যদি একটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে, তবে তাকে বাক্য বলে।

বাক্যের ক্ষুদ্রতম একক শব্দ।

একটি স্বার্থক বাক্য গঠনের শর্ত

একটি সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ বা শর্ত থাকা আবশ্যক। যথা:

ক. আকাঙ্ক্ষা খ. আসত্তি ও গ. যোগ্যতা।

ক. আকাঙ্ক্ষা কাকে বলে

বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা তা-ই আকাঙ্ক্ষা।

যেমন: চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে- এটুকু বললে বাক্যটি সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করে না, আরও কিছু শোনবার ইচ্ছা হয়। এই পরবর্তী অংশটি শোনার ইচ্ছাই হলো আকাঙ্ক্ষা। বাকাটি এভাবে পূর্ণাঙ্গ করা যায় চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। এখানে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয়েছে বলে এটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য।

খ. আসত্তি কাকে বলে

বাক্যের অর্থসংগতি রক্ষার জন্য ভাষার স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে পরস্পর অর্থসংগতি ও আকাঙ্ক্ষাযুক্ত পদসমূহের সুশৃঙ্খল বিন্যাসকেই আসত্তি বলে। অর্থাৎ মনোভাব প্রকাশের জন্য বাক্যে শব্দগুলো এমনভাবে পর পর সাজাতে হবে যাতে মনোভাব প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়।

যেমন: কাল বিতরণী হবে উৎসব আমাদের পুরস্কার অনুষ্ঠিত। পদ সন্নিবেশ ঠিকভাবে না হওয়ায় শব্দগুলোর অন্তর্নিহিত ভাবটি যথাযথ প্রকাশিত হয়নি। তাই এটি বাক্য হয়নি। মনোভাব পূর্ণভাবে প্রকাশ করার জন্য পদগুলোকে নিম্নলিখিতভাবে যথাস্থানে সন্নিবেশিত করতে হবে। যেমন 'কাল আমাদের স্কুলে পুরস্কার বিতরণী উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।' বাক্যটি আসত্তিসম্পন্ন।

গ. যোগ্যতা কাকে বলে

বাক্যস্থিত পদসমূহের পরস্পরের সঙ্গে অর্থগত এবং ভাবগত মেলবন্ধনের নাম যোগ্যতা।

যেমন : 'বর্ষার বৃষ্টিতে প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কারণ, বাক্যটিতে পদসমূহের অর্থগত এবং ভাবগত সমন্বয় রয়েছে। কিন্তু "বর্ষার রৌদ্র প্লাবনের সৃষ্টি করে। বললে বাক্যটি ভাবপ্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ, রৌদ্র প্লাবন সৃষ্টি করে না।

বাক্যে যোগ্যতা অর্জনে কয়েকটি বিষয়

বাক্যের যোগ্যতার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জড়িত থাকে। যেমন : ক. দুর্বোধ্যতা বর্জন খ. রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা, গ. উপমা ভুল প্রয়োগ, ঘ. বাহুল্য দোষ, ৫. বাগ্ধারায় শব্দ পরিবর্তন, চ. গুরুচণ্ডালী দোষ পরিহার ও ছ. যথার্থ শব্দ প্রয়োগ

নিম্নে বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো

ক. দুর্বোধ্যতা বর্জন: অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করলে বাক্যের যোগ্যতা বিনষ্ট হয়। যেমন : তুমি আমার সঙ্গে প্রপঞ্চ করেছো। (চাতুরী বা মায়া অর্থে, কিন্তু বাংলা 'প্রপঞ্চ' শব্দটি অপ্রচলিত)।

খ. রীতিসিদ্ধ অর্থবাচকতা: প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থে শব্দ সর্বদা ব্যবহৃত হয়। যোগ্যতার দিক থেকে রীতিসিদ্ধ অর্থের প্রতি খেয়াল রেখে কতগুলো শব্দ ব্যবহার করতে হয়। যেমন : 

বাধিত শব্দের অর্থ বাধাপ্রাপ্ত কিন্তু আমরা রীতিসিদ্ধ অনুসারে বাধিত শব্দটি অনুগৃহীত বা কৃতজ্ঞ অর্থে প্রয়োগ করি।

গ. উপমার ভুল প্রয়োগ: ঠিকভাবে উপমা অলংকার ব্যবহার না করলে যোগ্যতার হানি ঘটে। যেমন: আমার হৃদয়-মন্দিরে আশার বীজ উপ্ত হলো। বীজ ক্ষেতে বপন করা হয় মন্দিরে নয়। কাজেই বাক্যটি হওয়া উচিত : আমার হৃদয় ক্ষেত্রে আশার বীজ উপ্ত হলো।

ঘ. বাহুল্য-দোষ: প্রয়োজনের অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য দোষ ঘটে এবং এর ফলে শব্দ তার যোগ্যতাগুণ হারিয়ে থাকে। যেমন: দেশের সব আলেমগণই এ ব্যাপারে আমাদের সমর্থন দান করেন। আলেমগণ বহু বচনবাচক শব্দ। এর সঙ্গে 'সব' শব্দটির অতিরিক্ত ব্যবহার বাহুল্য দোষ সৃষ্টি করেছে।

ঙ. বাগ্‌ধারায় শব্দ পরিবর্তন: বাগ্‌ধারা ভাষাবিশেষের ঐতিহ্য। এর যথেচ্ছা পরিবর্তন করলে শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। যেমন: 'অরণ্যে রোদন' (অর্থ : নিষ্ফল আবেদন) এর পরিবর্তে যদি বলা হয়। 'বনে ক্রন্দন' তবে বাগধারাটি তার যোগ্যতা হারাবে।

চ. গুরুচণ্ডালী দোষ: তৎসম শব্দের সঙ্গে দেশীয় শব্দের প্রয়োগ কখনো কখনো গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে। এ দোষে শব্দ তার যোগ্যতা হারায়। 'গরুর গাড়ি', 'শবদাহ', 'মড়াপোড়া প্রভৃতি স্থলে যথাক্রমে 'গরুর শকট', 'শবপোড়া', 'মড়াদাহ' প্রভৃতির ব্যবহার গুরুচণ্ডালী দোষ সৃষ্টি করে।

ছ. যথার্থ শব্দ প্রয়োগ: অনেক সময় বাক্যে যথার্থ শব্দ প্রয়োগ না করে এমন শব্দ প্রয়োগ করা হয়, যা বাক্যকে অর্থহীন হাস্যকর করে তোলে। যেমন : ইংরেজি 'Give' শব্দের অর্থ দেওয়া', 'দেয়া' নয়। 'দেয়া' অর্থ মেঘ। কিন্তু অনেকে এর প্রকৃত অর্থ না জেনে না বুঝে লিখে ফেলেন নিচে দেয়া হলো। অর্থাৎ এর অর্থ দাঁড়ালো নিচে মেঘ হলো। এমনটি লেখা বিধেয় নয়। অর্থাৎ লিখতে হবে “নিচে দেওয়া হলো এটাই সমীচীন।

আরো পড়তে পারেন

বাক্যের শ্রেণীবিভাগ

বাক্য কাকে বলে
চিত্রে বাক্যের শ্রেণীবিভাগ দেখানো হয়েছে

গঠন অনুসারে বাক্যের শ্রেণীবিভাগ

গঠনগত দিক থেকে বাক্য তিন প্রকার। যথা :

১. সরল বাক্য (Simple Sentence)

২. জটিল বাক্য (Complex Sentence)

৩. যৌগিক বাক্য (Compound Sentence)

১. সরল বাক্য (Simple Sentence) কাকে বলে

কোনো বাক্য একটি উদ্দেশ্য ও একটিমাত্র ক্রিয়া সংবলিত হলে এবং অন্য কোনো বাক্যের সঙ্গে যুক্ত বা সম্পর্কিত না হলে তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন : রানা বই পড়ে।

২. জটিল বাক্য (Complex Sentence) কাকে বলে

একাধিক খণ্ডবাক্য আপেক্ষিক স্বাধীনতা ও অধীনতার সম্পর্ক স্বীকার করে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোনো বাক্য গঠিত হলে তাকে জটিল বাক্য বলে। যেমন : যদি পড় তবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে।

৩. যৌগিক বাক্য (Compound Sentence) কাকে বলে

পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বাক্য বা জটিল বাক্য যদি কোনো অব্যয় পদ যোগে সংযুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে তবে তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যেমন: তার বয়স হয়েছে কিন্তু বুদ্ধি হয়নি। তুমি অন্যায় করেছ সুতরাং তোমাকে শান্তি পেতে হবে।

বাগভঙ্গি বা অর্থানুসারে বাক্যের শ্রেণিবিভাগ 

বাগভঙ্গি বা অর্থানুসারে বাক্যকে প্রধানত সাত ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. বিবৃতিমূলক বা নির্দেশাত্মক বাক্য

২. প্রশ্নবোধক বা প্রশ্নাত্মক বাক্য

৩. অনুজ্ঞা বা আদেশসূচক বাক্য

৪. ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য

৫. কার্যকারণাত্মক বাক্য

৬. সংশয়সূচক বা সন্দেহদ্যোতক বাক্য

৭. বিস্ময় বা আবেগসূচক বাক্য

১. বিবৃতিমূলক বা নির্দেশাত্মক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্য সাধারণভাবে বিবৃত বা নির্দেশ করা হয়, তাকে বিবৃতিমূলক বা নির্দেশাত্মক বাক্য বলে। যেমন : সূর্য পূর্বদিকে ওঠে। তার বয়স হলেও বুদ্ধি হয়নি। সুদেষ্ণার নীল শাড়ি বিশেষ পছন্দের।

বিবৃতিমূলক বাক্য দুই প্রকার। যথা : ক. অস্তিবাচক বাক্য ক. নেতিবাচক বাক্য

ক. অস্তিবাচক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব বা হ্যাঁ-সূচক অর্থ প্রকাশ করে, তাকে অস্তিবাচক বাক্য বলে। যেমন: প্রিয়ংবদা যথার্থ কহিয়াছে। মিথ্যাবাদীকে সবাই অপছন্দ করে। বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। সাহিত্যে মানবত্ত্বা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ করে।

খ. নেতিবাচক বাক্য কাকে বলে

যখন যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্য অস্বীকৃতি, নিষেধ বা না-সূচক অর্থ বোঝায়, তখন তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে। যেমন: প্রিয়ংবদা অযথার্থ কহে নাই। মিথ্যাবাদীকে কেউ পছন্দ করে না। বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি কঠিন হয় না। সাহিত্যে মানবঙ্গা খেলা করে এবং সেই খেলার আনন্দ উপভোগ না করে পারে না।

২. প্রশ্নবোধক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে কোনো ঘটনা বা ভাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা বা প্রশ্নসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে। যেমন: আপনি কেন ভূতে বিশ্বাস করেন। এ বাসটা কখন ছাড়বে? ছেলেটা এ ভরদুপুরে কোথায় চলল। 

৩. অনুজ্ঞা বা আদেশসূচক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ, নিষেধ ইত্যাদি অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে অনুজ্ঞাসূচক বাক্য বলে। যেমন: সত্য কথা বলবে। সময় নষ্ট করো না। দ্যাখ না ওখানে কে বসে আছে।

৪. ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে ইচ্ছা, অভিপ্রায়, প্রার্থনা, কামনা বাসনা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়, তাকে ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য বলে। যেমন: আপনি দীর্ঘজীবী হোন। মহারাজের জয় হোক।

৫. কার্যকারণাত্মক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে ক্রিয়া নিষ্পত্তি কোনো বিশেষ শর্তের অধীনে এমন বোঝায়, তাকে কার্যকারণাত্মক বাক্য বলে। যেমন: সময় পেলে তোমার ওখানে যাবো। মন দিয়ে না পড়লে পাশ করা যায় না। যদি বল, আসব। রাত হলে চাঁদ দেখা যাবে। পা নেই বলে সে হাঁটতে পারে না।

৬. সংশয়সূচক বাক্য কাকে বলে

যে বর্ণনাত্মক বাক্যে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ, সংশয়, সম্ভাবনা, অনুমান, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ভাব প্রকাশ পায়, তাকে সংশয়সূচক বাক্য বলে। এ ধরনের বাক্যে হয়তো, বুঝি, সম্ভবত, বোধ হয়, নাকি, নিশ্চয় প্রভৃতি সংশয়সূচক ক্রিয়া-বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। যেমন: হয়তো তার আসা হবে না। বোধ হয় কাল তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

৭. বিস্ময় বা আবেগসূচক বাক্য কাকে বলে

যে বাক্যে আনন্দ-বেদনা, বিস্ময়-কৌতূহল, শোক, ক্রোধ-ঘৃণা, আবেগ-উচ্ছ্বাস ইত্যাদি ভাব প্রকাশ পায়, তাকে বিস্ময় বা আবেগসূচক বাক্য বলে। যেমন : ছিঃ ছিঃ। তুমি এত নীচ। ইস্, আঙুলটা পুরো থেঁতলে গেছে। বাপ রে! কী প্রচণ্ড গরম।

আমাদের শেষ কথা

আশা করি বাক্য কাকে বলে বাক্যের শ্রেণীবিভাগ উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনাটি তোমার সফলতায়  অবদান রাখবে। তোমার কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমাদেরকে কমেন্টে বা ফেসবুকের জানাতে পারো। পড়াশোনা সম্পর্কে বিভিন্ন আর্টিকেল পেতে আমাদের সঙ্গেই থাক। ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দিও। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আল্লাহ হাফেজ...

জুয়েল

আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা কোনো বাণিজ্যিক পণ্য নয়। শিক্ষা সকলের অধিকার। আসুন আমরা প্রত্যেক শিশুর স্বপ্ন জয়ের সারথি হই

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন