প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণে অনুসারে পদ মোট পাঁচ প্রকার। এর মধ্যে দ্বিতীয় পদ সর্বনাম। সর্বনাম অর্থ নামের পরিবর্তে। যে পদ বিশেষ্য বা নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় তাই সর্বনাম। ইংরেজিতে সর্বনাম পদকে Pronoun বলে। পদ সমন্ধে ধারাবাহিক লেখার মধ্যে আজকের আলোচ্য বিষয় সর্বনাম পদ কাকে বলে এবং প্রয়োজনীয় উদাহরণসহ সর্বনাম পদের শ্রেণীবিভাগ। এর আগের আর্টিকেলে বিশেষ্য পদ কাকে বলে শ্রেণি বিভাগসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
সর্বনাম পদ কাকে বলে |
সর্বনাম পদ কাকে বলে
সর্বনাম
: বিশেষ্যের পরিবর্তে যে শব্দ ব্যবহৃত
হয়, তাকে সর্বনাম পদ বলে। সর্বনাম
সাধারণত বিশেষ্যের প্রতিনিধি স্থানীয় শব্দ। যেমন : হস্তী প্রাণিজগতের সর্ববৃহৎ প্রাণী। তার শরীরটি যেন বিরাট এক মাংসের স্তূপ।
দ্বিতীয়
বাক্যে 'তার' শব্দটি প্রথম বাক্যের 'হস্তী' বিশেষ্য পদটির প্রতিনিধি স্থানীয় শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই ‘তার শব্দটি সর্বনাম পদ অনুক্ত থাকলে
ও ক্ষেত্রবিশেষে বিশেষ্য পদের পরিবর্তে সর্বনাম পদ ব্যবহৃত হতে
পারে। যেমন :
ক.
যারা দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারে, তারাই তো সত্যিকারের দেশপ্রেমিক।
খ.
ধান ভানতে যারা শিবের গীত গায়, তারা স্থির লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।
সর্বনাম পদ কত প্রকার ও কী কী
সর্বনামের
শ্রেণিবিভাগ : বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সর্বনামসমূহ মোট ১২ প্রকারের হয়ে
থাকে। যথা :
১.
ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক সর্বনাম,
২. আত্মবাচক সর্বনাম, ৩. সামীপ্যবাচক সর্বনাম,
৪. দূরত্ববাচক সর্বনাম, ৫. সাকুল্যবাচক সর্বনাম,
৬. প্রশ্নবাচক সর্বনাম, ৭. অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক সর্বনাম, ৮.
সংযোগজ্ঞাপক সর্বনাম, ৯. ব্যতিহারিক বা
পারস্পরিক সর্বনাম, ১০. অন্যাদিবাচক সর্বনাম, ১১. যৌগিক সর্বনাম (অনিশ্চয়বাচক) এবং ১২. সাপেক্ষ বা প্রতিনির্দেশক সর্বনাম
১. ব্যক্তিবাচক বা পুরুষবাচক সর্বনাম কাকে বলে
ব্যক্তিবাচক
বা পুরুষবাচক : বাক্যের ব্যাকরণিক পক্ষ বা পুরুষ (বক্তা,
শ্রোতা, অন্য- এ তিনটি) নির্দেশ
করে। যেমন : আমি, আমরা, তুমি, তোমরা, সে, তারা, তাহারা, তিনি, তাঁরা, এ, এরা, ও,
ওরা ইত্যাদি। বচনভেদে যেমন এদের রূপের পার্থক্য (আমি, আমরা) হয়, তেমনি কারকভেদেও এদের অন্যান্য রূপ (আমাকে, আমার) তৈরি হয় ।
২. আত্মবাচক সর্বনাম কাকে বলে
আত্মবাচক
: কর্তা নিজেই কোনো কাজ করছে-এ ভাবটি জোর
দিয়ে বোঝানোর জন্য যে ধরনের সর্বনাম
ব্যবহার হয়, তাকে আত্মবাচক সর্বনাম বলে। যেমন : স্বয়ং, নিজে, খোদ, আপনি। আর এ ধরনের
সর্বনাম বাক্যের কর্তার সঙ্গে অভিন্নতা নির্দেশ করে। যেমন : সে নিজে অঙ্কটা
করেছে। তিনি স্বয়ং আমাকে দেখতে আসবেন। যাত্রীরা স্ব স্ব আসনে গিয়ে বসলেন।
৩. সামীপ্যবাচক সর্বনাম কাকে বলে
সামীপ্যবাচক
: সামীপ্যবাচক সর্বনাম সুনির্দিষ্ট কোনো বিশেষ্যের পরিবর্তে কিংবা দূরত্ব ও দিকের বিচারে
নৈকট্য প্রকাশে ব্যবহার হয়। যেমন : ওই আমাদের গাঁ।
এখানে 'ওই শব্দটি উত্তর,
দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম ইত্যাদি
সুনির্দিষ্ট বিশেষ্যের পরিবর্তে বসেছে। কতিপয় সামীপ্যবাচক সর্বনাম : এ, এই, এরা,
ইহারা, ইনি, ইত্যাদি।
৪. দূরত্ববাচক সর্বনাম কাকে বলে
দূরত্ববাচক
: দূরত্ববাচক সর্বনাম দূরের কিছু বোঝায়। যেমন: ঐ, ঐসব, সব।
৫. সাকুল্যবাচক সর্বনাম কাকে বলে
সাকুল্যবাচক
: যেসকল সর্বনাম ব্যক্তি, বস্তু বা ভাবের সামগ্রিক
সমষ্টি বোঝায় তাদেরকে সাকুল্য বাচক সর্বনাম বলে। যেমন : সব, সকল, সমুদয়, তাবৎ।
৬. প্রশ্নবাচক সর্বনাম কাকে বলে
প্রশ্নবাচক
: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রশ্ন
তৈরির জন্য বাক্যে প্রশ্নবাচক সর্বনাম অর্থাৎ কে, কি, কী, কোন, কাহার, কার, কিসে? ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। যেমন : ওখানে কে? কারা দেশের সর্বনাশ করতে চায়? টাকাটা কার কাছে দিয়েছ? কে এ মুখোশধারী?
আরো পড়তে পারেন
৭. অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক সর্বনাম কাকে বলে
অনির্দিষ্টতাজ্ঞাপক
: অনির্দিষ্ট বা পরিচয়হীন কোনো
কিছুকে বুঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহৃত
হয় তাই অনির্দিষ্টজ্ঞাপক সর্বনাম। কোনো, কেহ, কেউ, কিছু এগুলো হলো অনির্দিষ্টজ্ঞাপক সর্বনাম। যেমন : কেউ কোথাও আছে বলে মনে হয় না। কেউ কেউ ঘটনাটা জানবেন ।
নোট:
তির্যক উল্লেখে, বা পরিচয়ে গোপন
করার লক্ষ্যেও অনেক সময়ে এ ধরনের শব্দাবলি
অনির্দিষ্ট সর্বনামের মতো ব্যবহার হয়। যেমন : একজন এসেছিল। একটা কেউ যাবে।
৮. সংযোগজ্ঞাপক সর্বনাম কাকে বলে
সংযোগজ্ঞাপক
সর্বনাম: যে সর্বনাম দুটি
বাক্যের সংযোগ ঘটায় তাদেরকে সংযোগজ্ঞাপক সর্বনাম বলে। যে, যিনি, যাঁরা, যাহারা ইত্যাদি হলো সংযোগজ্ঞাপক সর্বনাম। যেমন স্টেশনে এসে দেখি যে, ট্রেনটা চলে গেছে।
৯. ব্যতিহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম কাকে বলে
ব্যতিহারিক
বা পারস্পরিক: দুপক্ষের সহযোগ বা পারস্পরিক নির্ভরতা
বোঝালে ব্যতিহারিক বা পারস্পরিক সর্বনাম
হয়। যেমন: তোমরা নিজেরা নিজেরা সমস্যাটি মিটিয়ে ফেল। কয়েকটি ব্যতিহারিক সর্বনাম: আপনা আপনি, নিজে নিজে, আপসে, পরস্পর ইত্যাদি।
১০. অন্যাদিবাচক সর্বনাম কাকে বলে
অন্যাদিবাচক
: নিজ ভিন্ন অন্য কোনো অনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝাতে যে সর্বনাম ব্যবহৃত
হয় তাই অন্যাদিবাচক সর্বনাম। অন্য, অপর, পর ইত্যাদি হলো অন্যাদিবাচক সর্বনাম। যেমন : অন্যের সমালোচনা করবে, তা আমি সইব
না।
১১. যৌগিক সর্বনাম কাকে বলে
যৌগিক
সর্বনাম (অনিশ্চয়বাচক) : একাধিক শব্দ একত্র হয়ে একটি সর্বনাম তৈরি করে, তখন তাকে যৌগিক সর্বনাম বলে। যেমন: অন্য কিছু, অন্য-কেউ, আর-কিছু, আর-
কেউ, কেউ-না, কেউ-বা ,যা-কিছু, যে-কোনো ইত্যাদি।
যৌগিক সর্বনাম | প্রায়োগিক ব্যবহার |
---|---|
কেই-বা | এই বৃষ্টিতে কেই-বা আসবে? |
আর কেউ | আর-কেউ যাবে? |
আর কিছু | আর কিছু চাই আপনার |
অন্য কিছু | আমার যা আছে তা-ই নিলাম, অন্য কিছু চেয়ো না। |
অন্য কেউ | একথা তুমি ছাড়া অন্য কেউ জানে না। |
কেউ-না-কেউ | কেউ-না-কেউ তো সংবাদ দিয়েছেই, নইলে সে আসবে কেন? |
যে-কেউ | যে-কেউ এ কাজ করতে পারে। |
১২. সাপেক্ষ বা প্রতিনির্দেশক সর্বনাম
সাপেক্ষ
বা প্রতিনির্দেশক সর্বনাম: পরস্পর শর্ত বা সম্পর্কযুক্ত একাধিক
সর্বনাম পদ একই সঙ্গে
ব্যবহৃত হয়ে দুটি বাক্যের সংযোগ সাধন করলে, তাদের সাপেক্ষ সর্বনাম বলে। যেমন: যা ভেবেছি তাই
হয়েছে।
প্রতিনির্দেশক সর্বনাম | প্রতিনির্দেশক সর্বনাম |
---|---|
যত চাও তত লও । | যত চেষ্টা করবে ততই সাফল্যের সম্ভাবনা। |
যত গর্জে তত বর্ষে না। | যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। |
যেমন কর্ম তেমন ফল । | জোর যার মুলুক তার। |
যেই কথা সেই কাজ। | যে আগে আসবে সে আগে পাবে। |
সর্বনামের রূপভেদ
সাধারণ অর্থে | |
---|---|
উত্তম পুরুষ | আমি, আমরা, আমাকে, আমার, আমাদিগকে, আমাদের (কবিতায় :মোর,মোরা) |
মধ্যম পুরুষ | তুমি, তোমরা তোমাকে, তোমাদিগকে, তোমার, তোমাদের |
নাম পুরুষ | সে, তারা, তাহারা, তাকে, তাহাকে। |
সম্ভ্রমাত্মক অর্থে | |
---|---|
মধ্যম পুরুষ | আপনি, আপনারা, আপনাকে, আপনার, আপনাদের |
নাম পুরুষ | তিনি, তাঁরা, তাঁদের, তাঁদেরকে, তাঁকে ইনি, এঁর, এঁদের, এঁকে, উনি ওঁর, এঁরা ওঁদের। |
তুচ্ছার্থক বা ঘনিষ্ঠতাজ্ঞাপক অর্থে | |
---|---|
মধ্যম পুরুষ | তুই, তোরা, তোর তোদের, তোকে |
নাম পুরুষ | ইহা ইহারা এই, এ, এরা, উহা উহারা, ও ওরা, ওদের |
আমাদের শেষ কথা
আরো পড়তে পারেন