ব্যাকরণকে বলা চলে ভাষার বিশ্লেষক । ভাষার অবয়ব গঠিত হয় নানা উপাদান ব্যাকরণ ভাষার সেই উপাদান সমূহের স্বরূপ ও প্রকৃতি উদ্ঘাটনপূর্বক তার রক্ষার সুশৃঙ্খল নিয়ম কানুন তৈরি করে এবং তাঁর প্রয়োগ রীতিগুলোকে সূত্রবদ্ধ করে ভাষাকে বিচ্যুতির হাত হতে রক্ষা করে । ব্যাকরণকে তাই বলা হয় ভাষার নিয়ম বা আইন বা এককথায় ভাষার সংবিধান ।
তবে ব্যাকরণের প্রকৃতি নির্দেশাত্মক নয়, বর্ণনাত্মক। যদিও বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস বেশ পুরানো তবে সময়ের সাথে এর মধ্যে এসেছে পরিবর্তন, পরিবর্ধন। নিচের আর্টিকেলে আমরা নবম-দশম শ্রেণির বোর্ড বইয়ের আলোকে আধুনিক তথ্য উপাত্ত সমৃদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ দিয়েছি। যার সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক।
বাংলা ব্যাকরণ |
ব্যাকরণ শব্দের ব্যুৎপত্তি
‘ব্যাকরণ' একটি তৎসম শব্দ। শব্দটির গঠন প্রক্রিয়া
বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় দুটি উপসর্গ (বি,আ) । একটি ক্রিয়ামূল বা ধাতু (√কৃ) এবং একটি কৃৎ- প্রত্যয় (অনট> অন) । অর্থাৎ ব্যাকরণ শব্দটির বিশ্লেষণ
হলো- বি + আ - √ কৃ+ অনট>অন= ব্যাকরণ।
ব্যাকরণ শব্দের অর্থ কি
ব্যাকরণ
শব্দের অর্থ, বিশেষভাবে বিশ্লেষণ ।
ব্যাকরণ কাকে বলে
যে
শাস্ত্রে কোন ভাষার বিভিন্ন উপাদানের প্রকৃতি ও স্বরূপের বিচার বিশ্লেষণ করা হয় এবং
বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক নির্ণয় ও প্রয়োগবিধি বিশদভাবে আলোচিত হয়, তাকে ব্যাকরণ
বলে।”
বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে
ভাষা
মাত্রই কিছু নিজস্বতা আছে। সেই নিজস্বতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ব্যাকরণ । বাংলা
ব্যাকরণ বলতে বুঝায় - “ যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার বিভিন্ন উপাদানের গঠন প্রকৃতি
ও স্বরূপ বিশ্লেষিত হয় এবং এদের সম্পর্ক ও সুষ্ঠু প্রয়োগবিধি আলোচিত হয়, তাকে
বাংলা ব্যাকরণ বলে ।”
ড.
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) এর মতে, “যে শাস্ত্র
পাঠ করিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধ রূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ
বলে।”
ড.
সুকুমার সেন (১৯০০-১৯৯২) এর মতে, “যে শাস্ত্রে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতির বিচার
বিশ্লেষণ আছে এবং যে শাস্ত্রে জ্ঞান থাকলে বাংলা ভাষা শুদ্ধ রূপে বলতে, লিখতে ও শিখতে
পারা যায়, তাকে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বলে ।”
ড.
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) এর মতে, “যে শাস্ত্র দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ, প্রকৃতি ও প্রয়োগনীতি
বিশেষভাবে নির্ণয় করা হয়, তাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে ।”
ড.
এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২) এর মতে, “যে শাস্ত্র দ্বারা বাংলা শব্দ বা ভাষা ব্যকৃত অর্থাৎ
অভিব্যুৎপাদিত হয়, তার নাম ব্যাকরণ ।”
বাংলা ব্যাকরণ শাস্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ
ব্যাকরণের
মূল ভিত্তি হলো ভাষা । আগে ভাষার সৃষ্টি তারপর ভাষার সুশৃঙ্খলিত নিয়মাবলি নির্ণয়ের
উদ্দেশ্যে ব্যাকরণ শাস্ত্রের উদ্ভব হয় বাংলা ব্যাকরণের চর্চা ও উদ্ভবের ইতিহাস খুব
বেশি দিনের নয় । ইউরোপীয় বণিক সম্প্রদায় ও মিশনারিরা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ ও ধর্ম
প্রচারের প্রয়োজনে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং তাদের প্রচেষ্টাতেই
প্রথম বাংলা ব্যাকরণ শাস্ত্রের সূত্রপাত হয় ।
পর্তুগিজ
পাদ্রি ম্যানুয়েল দ্য আস সুম সাও সর্বপ্রথম রোমান হরফে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন ১৭৩৪
খ্রিস্টাব্দে । ইংরেজ পণ্ডিত নেদানিয়েল ব্রাসি হেলহেড বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করেন
এবং ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়। তারপর ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কেরি সাহেব
ব্যাকরণ রচনা করেন ।
প্রথম
বাঙালি ব্যাকরণ রচয়িতা হিসেবে গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ্য। তাঁর রচিত ব্যাকরণ
১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় — গৌড়ীয় ব্যাকরণ' নামে একটি ব্যাকরণ রচনা করেন সেটি ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে
কলকাতার স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশ করে । অতঃপর ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ড. মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ, ড. সুকুমার সেন, ড. মু. এনামুল হক প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ বাংলা ব্যাকরণ রচনায়
প্রয়াস পান ।
বাংলা ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা
ব্যাকরণের
মূল ভিত্তি ভাষা । ব্যাকরণ ভাষাকে অনুশাসন করে না। কিংবা ভাষা সৃষ্টির জন্য ব্যাকরণ
প্রয়োজন হয় না । ভাষা সৃষ্টির পর সে ভাষাকে বিশ্লেষণ করে যে সমস্ত নিয়ম-নীতি রচিত
সেগুলোকে লিপিবদ্ধ করার জন্যই ব্যাকরণ শাস্ত্রের সৃষ্টি তবুও ব্যাকরণ পাঠ আবশ্যক কারণ-
ক.
ব্যাকরণ ভাষাকে সর্বপ্রকার বিচ্যুতির হাত হতে রক্ষা করে ।
খ.
ব্যাকরণ ভাষা সম্পর্কে শুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও জ্ঞানদান করে ।
গ.
ব্যাকরণ ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম শৃঙ্খলা ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগবিধি সম্পর্কে সচেতনতা
দান করে ।
ঘ.
ভাষার সৌন্দর্য সৃষ্টির নিয়ম কানুনও ব্যাকরণ শাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে
ঙ.
সর্বোপরি সাহিত্য রস আস্বাদানের জন্য ব্যাকরণ পাঠ প্রয়োজন ।
একটি
কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে- ভাষা আগে, ব্যাকরণের উদ্ভব পরে । অর্থাৎ ভাষার নিজস্ব কাঠামো
পেলে ব্যাকরণ তার স্বরূপ ও পদ্ধতি আলোচনা করে মাত্র । আর এটাই ব্যাকরণের প্রকৃতি। এ
প্রকৃতি বর্ণনাত্মক Descriptive), নির্দেশাত্মক (Precritive) নয় । অতএব ব্যাকরণ ভাষাকে
যেমন নির্দেশ দেয় না, তেমনি শাসনও করে না; শুধু মাত্র বর্ণনা করে ।
ব্যাকরণ কত প্রকার ও কি কি
ব্যাকরণের
আলোচ্য বিষয় ও প্রকৃতি অনুসারে ব্যাকরণ চার প্রকার। যথা:
ক.
বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ,
খ.
ঐতিহাসিক ব্যাকরণ,
গ.
তুলনামূলক ব্যাকরণ,
ঘ.
দার্শনিক বিচারসূচক ব্যাকরণ ।
ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়
পৃথিবীর
যে কোন ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি মৌলিক অংশ পাওয়া যায়। যথা: ১. ধ্বনি (Sound),
২. শব্দ (Word), ৩. বাক্য (Sentence)। আর সব ভাষারই ব্যাকরণে প্রধানত এ তিনটি বিষয়
আলোচনা করা হয়
২.
শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব (Morphology) এবং
৩.
বাক্যতত্ত্ব বা বাক্যক্রম (Syntax)।
এ
ছাড়া ছন্দ ও অলংকারকে ব্যাকরণের আনুষঙ্গিক আলোচ্য বিষয় বলে গণ্য করা হয় । ব্যাকরণের
উচ্চতর পর্যায়ে বাগর্থ বিজ্ঞান বা অর্থ তত্ত্ব (Semantics) এবং অভিধানতত্ত্ব
(Lexi cograpley) ও আলোচিত হয় ।
১. ধ্বনি তত্ত্ব (Phonetics) কাকে বলে
ধ্বনি
: মানুষের বাক্ প্রত্যঙ্গজাত অর্থাৎ কণ্ঠনালী, মুখবিবর, জিহ্বা, আল-জিহ্বা, কোমল তালু,
শক্ত তালু, দাঁত, মাড়ি, চোয়াল, ঠোঁট ইত্যাদির সাহায্যে উচ্চারিত আওয়াজকে ধ্বনি বলে।
বাক্ প্রত্যঙ্গজাত ধ্বনির সূক্ষ্মতম মৌলিক বা একক (Unit)- কে ধ্বনি একক বলে।
ধ্বনিতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়
ধ্বনিতত্ত্বের
আলোচ্য বিষয় হলো- ধ্বনির উচ্চারণ প্রণালী, উচ্চারণের স্থান, ধ্বনির প্রতীক বা বর্ণের
বিন্যাস, ধ্বনি-সংযোগ বা সন্ধি, ধ্বনির পরিবর্তন ও লোপ, ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধান, যুক্তাক্ষর
৷ নিচে লিংকসহ
ধ্বনি
ও বর্ণ :
সন্ধি
:
ষ-ত্ব বিধান :
ণ-ত্ব বিধান : ণত্ব বিধানের সহজ নিয়ম
যুক্তাক্ষর
:
২. শব্দতত্ত্ব বা রূপতত্ত্ব কাকে বলে
এক
বা একাধিক ধ্বনি যোগে গঠিত হয় শব্দ (Word), ধ্বনি যেমন শব্দের ক্ষুদ্রতম একক, শব্দ
তেমনি বাক্যের ক্ষুদ্রতম একক ।
শব্দতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়
শব্দতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হলো- বাক্যে ব্যবহৃত শব্দ বা পদের বিভিন্ন
গঠন প্রকৃতিগত বিশ্লেষণ। যেমন: শব্দমূল, শব্দের বানান, শব্দ, শব্দের ব্যুৎপত্তি, শব্দের
গঠন, পদের পরিচয়, উপসর্গ, অনুসর্গ, কারক ও বিভক্তি, বচন, লিঙ্গ, ধাতু, সমাস, প্রকৃতি
ও প্রত্যয়, ক্রিয়ার কাল ও পুরুষ । নিচে লিংকসহ
ক্রিয়া
মূল বা ধাতু :
পদের
পরিচয় :
ক্রিয়া : ক্রিয়া কাকে বলে শ্রেণিবিভাগসহ বিস্তারিত
অনুসর্গ
:
কারক
ও বিভক্তি :
সমাস
:
বচন
:
ক্রিয়ার
কাল :
শব্দের
বানান :
সম্বন্ধ পদ : সম্বন্ধ পদ কাকে বলে? সম্বন্ধ পদে কোন বিভক্তি যুক্ত হয়? বিস্তারিত জেনে নিন।
দ্বিরুক্ত শব্দ : দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে ? দ্বিরুক্ত শব্দ কত প্রকার জানুন বিস্তারিত
পদাশ্রিত নির্দেশক : পদাশ্রিত নির্দেশক কাকে বলে এর ব্যবহার সম্পর্কে জানুন বিস্তারিত
৩. বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম কাকে বলে
মানুষের বাপ্রত্যঙ্গজাত ধ্বনিসমন্বয়ে গঠিত শব্দসহযোগে সৃষ্ট
অর্থবোধক বাক্ প্রবাহের এক একটি অর্থপূর্ণ অংশকে বাক্য বলে ।
বাক্যতত্ত্বের আলোচ্য বিষয়
বাক্যতত্ত্বের আলোচ্য বিষয় হলো- বাক্যের সঠিক গঠন প্রণালী, বিভিন্ন
উপাদানের সংযোজন, বিয়োজন, এদের সার্থক ব্যবহার, বাক্যে শব্দ বা পদের স্থান, পদের রূপ
পরিবর্তন, এককথায় প্রকাশ, বাগ্ধারা, বিরাম চিহ্ন, বাচ্য ইত্যাদি। নিচে লিংকসহ
বাক্য
:
উক্তি
পরিবর্তন :
এক কথায়
প্রকাশ :
বিরাম
চিহ্ন :
বাক্যে
শব্দের সার্থক ব্যবহার :
যোজক
:
বাচ্য
:
অর্থ তত্ত্ব (Semantics) - এর আলোচ্য বিষয়
শব্দের অর্থ বিচার, অর্থের বিভিন্ন প্রকারভেদ ( যেমন: মুখ্যার্থ,
গৌণার্থ, বিপরীত অর্থ, সমার্থক শব্দ) ইত্যাদি অর্থতত্ত্বরের আলোচ্য বিষয়। নিচে লিংকসহ
বিপরীত
শব্দ :
সমার্থক
শব্দ :
আমাদের শেষ কথা
আশা
করি অন্বেষা.নেট - এর বাংলা ব্যাকরণ তোমার সফলতায় অবদান রাখবে। তোমার কোনো
প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমাদেরকে কমেন্টে বা ফেসবুকের জানাতে পারো। পড়াশোনা সম্পর্কে
বিভিন্ন আর্টিকেল পেতে আমাদের সঙ্গেই থাক। ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও
জানার সুযোগ করে দিও। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আল্লাহ
হাফেজ...