মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণাকে পরমাণু বলে। পরমাণুকে ভাঙ্গলে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌলিক পদার্থ ৯৮ টি আর ২০ টি মৌলিক পদার্থ গবেষণাগারে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমাদের দৈনিন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার রয়েছে। তাই তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
তেজস্ক্রিয়তা কি বা তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে? বিষয়টাকে ভালো করে বুঝার জন্য আমাদেরকে পরমাণুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হবে। তেজস্ক্রিয়তার বিষয়টাকে ভালো করে ব্যাখ্যা করার জন্য পরমাণু সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি ধৈর্য্যসহকারে পড়বেন।
তেজস্ক্রিয়তা কি
প্রত্যেকটি মৌলিক পদার্থের পরমানুই ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি। পরমাণুর মাঝখানে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে যাকে পরমাণুর নিউক্লিয়াস বলে। নিউক্লিয়াসের বাইরে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ইলেকট্রেন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরে। প্রোটন ধনাত্মক, ইলেকট্রন ঋণাত্মক আর নিউট্রন চার্জ নিরপেক্ষ। একটি পরমাণুতে যতটি ইলেকট্রন থাকে ঠিক ততটিই প্রোটন থাকে। যার কারণে পরমাণু চার্জ নিরপেক্ষ হয়।
বিদ্যমান সকল মৌলিক পদার্থই ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। প্রতিটি মৌলিক পদার্থের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আমরা যে পার্থক্য দেখতে পাই সেটি আসলে পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার পার্থক্যের কারণে হয়ে থাকে। সোনা, রূপা, তামা, দস্তা অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি আসলে আলাদা কিছু নয়। এগুলো সব কিছুই ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের তৈরি। এগুলোর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য দেখা যায় সেটি হয়ে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার তারতম্যের কারণে।
সোনার একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে রয়েছে ৭৯টি প্রোটন ও ১১৮ টি
নিউট্রন। ওদিকে লোহার নিউক্লিয়াসে রয়েছে ২৬ টি প্রোটন
এবং ৩০ টি নিউট্রন।
এখন কোনো ভাবে যদি লোহার প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যাকে
যথাক্রমে ৭৯ ও ১১৮
- তে উন্নিত করা যায় তাহলে লোহাটিই সোনায় পরিণত হবে।
আরো পড়তে পারেন
আমরা
আমাদের চারপাশে যে সকল যৌগিক
পদার্থ দেখি সেগুলো মূলত একাধিক মৌলিক পদার্থ পরস্পরের সাথে ইলেকট্রন বিনিময় করে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গাঠনিক কোনো পরিবর্তন হয় না। শুধু
মাত্র পরমাণুর নিউক্লিয়াসের বাইরে বিদ্যমান ইলেকট্রন সংখ্যার হ্রাস - বৃদ্ধি ঘটে।
অন্যদিকে
বিশাল পরিমাণে শক্তির উপস্থিতিতে পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে একটি প্রোটন কণা একটি ইলেকট্রন কণা শোষণ করে নিউট্রনে পরিণত হতে পারে। আবার একইভাবে একটি নিউট্রন কণা তার মধ্য থেকে ঋণাত্মক ইলেকট্রন কণা বের করে দিয়ে প্রোটন কণায় পরিণত হতে পারে। পারমাণবিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গাঠনিক পরিবর্তন হয়।অর্থ্যাৎ একটি মৌল অন্য একটি মৌলি পরিণত হয়।
আইসোটোপ কাকে বলে
সাধারণত
কোনো মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন সংখ্যা প্রোটন সংখ্যার সমান বা কয়েকটা বেশি
থাকে। কিন্তু কখনো কখনো একটি নির্দিষ্ট মৌলের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুতে প্রোটন সংখ্যা (পারমাণবিক সংখ্যা) সমান থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক নিউট্রন পাওয়া যায় । যেগুলোকে একটিকে
অপরটির আইসোটোপ বলে। আইসোটোপ ছবি : https://creativecommons.org
এই আইসোটোপের কোনো কোনোটি প্রকৃতিতে অস্থিতিশীল অবস্থায় থাকে। অস্থিতিশীল আইসোটোপগুলো স্থিতিশীলতা অর্জন করার জন্য ধীরে ধীরে ( অলফা, বিটা, গামা) ক্ষয়ের মাধ্যমে নিজেদের নিউক্লিয়াসের গঠনের পরিবর্তন করে অন্য একটি মৌলিক পদার্থে পরিণত হয়। আইসোটোপের এই অস্থিতিশীলতারই আরেক নাম হচ্ছে রেডিও অ্যাকটিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা। এবং যে সকল নিউক্লিয়াস তেজস্ক্রিয়তা প্রদর্শন করে তাদের তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস বলে। আর যে প্রক্রিয়ায় আইসোটোপগুলো ক্ষয় হতে হতে আরেকটি পদার্থে পরিণত হয় তাকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় ক্ষয়।
তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে
যে প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে একটি অস্থিতিশীল পরমাণুর নিউক্লিয়াস আয়নাইজিং বিকিরণে আলফা কণা, বিটা কণা,গামা রশ্মি নির্গত করে শক্তি হারায় তাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে
অর্থ্যাৎ তেজস্ক্রিয়তা
হলো যেসকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২ এর বেশি,
তাদের নিউক্লিয়াস দ্রুত গতির নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উচ্চভেদন সম্পূর্ণ বিকিরণ নির্গত হওয়ার ঘটনা। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌল সমূহের মধ্যে তেজস্ক্রিয় মৌল ১৪ টি। উইকিপিডিয়া
এই
তেজস্ক্রিয় ক্ষয় মূলত তিন প্রক্রিয়ায় ঘটে। যথা: ১. আলফা ( α ) ২. বিটা
( β ) ৩. গামা ( ϒ )
আলফা, বিটা ও গামা ক্ষয় ছবি: https://creativecommons.org |
আলফা ( α ) ক্ষয় কাকে বলে
আলফা কণা তৈরি হয় দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন কণার সমন্বয়ে। প্রতিবারের আলফা ক্ষয়ে মূলত আইসোটোপের নিউক্লিয়াস হতে দুটি প্রোটন ও দুটি নিউট্রন হারায় বা চার একক ভর হারায়। আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে আইসোটোপ চার এককের ভর সংখ্যা হারালেও প্রোটন সংখ্যা বা পারমানুবিক সংখ্যা হারায় মাত্র দুই একক।
আলফা
কণাগুলি সাধারণত বড় আকারের তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস যেমন ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, অ্যাক্টিনিয়াম এবং রেডিয়ামের পাশাপাশি ট্রান্সআরনিক উপাদানগুলির দ্বারা নির্গত হয়।
বিটা ( β ) ক্ষয় কাকে বলে
বিটা ক্ষয়ের ক্ষেত্রে আইসোটোপ পরুমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা নিউট্রন কণা ( চার্জ নিরপেক্ষ কণা) তার মধ্যে থাকা একটি ইলেকট্রন কণা (ঋণাত্মক কণা) বের করে দিয়ে প্রোটন কণায় (ধনাত্মক কণা) পরিণত হয়।
গামা ক্ষয় ( ϒ ) কাকে বলে
একটি নিউক্লিয়াস আলফা বা বিটা ক্ষয়ের
পর উত্তেজিত স্তরে চলে যায়। কিন্তু নিউক্লিয়াসটি দীর্ঘক্ষণ উত্তেজিত স্তরে থাকে না। অল্প সময় ব্যবধানে তা আলোক রশ্মি
বিকিরণ করে নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসে। এই বিকিরণকে গামা
রশ্মি বলে। গামা ক্ষয় বলতে এই গামা রশ্মির
বিকিরণকেই বুঝায়।
তেজস্ক্রিয়তার বৈশিষ্ট্য
তেজস্ক্রিয়তার
বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
(i) তেজস্ক্রিয়তা
হল নিউক্লিয় ঘটনা, এর সঙ্গে নিউক্লিয়াস
বহির্ভূত ইলেকট্রনগুলির সম্পর্ক নেই।
(ii) 83-এর
বেশি পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট মৌলগুলির তেজস্ক্রিয়তা দেখা যায়।
(ii) যে মৌলের পরমাণুর নিউট্রন ও প্রোটন সংখ্যার অনুপাত 1 : 5-এর বেশি হয় সেই মৌলের তেজস্ক্রিয় ধর্ম দেখা যায়।
(v) তেজস্ক্রিয়তা
হল নিউক্লিয়াসের ভাঙন বা বিঘটন। এই
বিঘটনের ফলে একটি মৌল সম্পূর্ণ নতুন রাসায়নিক ও ভৌত ধর্ম বিশিষ্ট নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
আমাদের শেষ কথা
আশা
করি তেজস্ক্রিয়তা কাকে বলে শিরোনামের আর্টিকেলটি তোমার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। তোমার কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে
আমাদেরকে কমেন্টে বা ফেসবুকের জানাতে
পারো। পড়াশোনা সম্পর্কে বিভিন্ন আর্টিকেল পেতে আমাদের সঙ্গেই থাক। ভাল লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও জানার সুযোগ করে দিও। ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। আল্লাহ হাফেজ...